দ্বিতীয় খণ্ড - অষ্টাদশ অধ্যায়: তীর্থদর্শন ও হৃদয়রামের কথা
হৃদয়ের অদ্ভুত দর্শন
মথুরের সহিত ঠাকুরের ঐরূপ কথাবার্তার কয়েক দিন পরে একদিন রাত্রে ঠাকুরকে পঞ্চবটী-অভিমুখে যাইতে দেখিয়া, তাঁহার প্রয়োজন হইতে পারে ভাবিয়া, হৃদয় গাড়ু ও গামছা লইয়া তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাইতে লাগিল। যাইতে যাইতে হৃদয়ের এক অপূর্ব দর্শন উপস্থিত হইল। সে দেখিতে লাগিল, ঠাকুর স্থূল রক্ত-মাংসের দেহধারী মনুষ্য নহেন, তাঁহার দেহনিঃসৃত অপূর্ব জ্যোতিতে পঞ্চবটী আলোকিত হইয়া উঠিয়াছে, এবং চলিবার কালে তাঁহার জ্যোতির্ময় পদযুগল ভূমি স্পর্শ না করিয়া শূন্যে শূন্যেই তাঁহাকে বহন করিতেছে! চক্ষুর দোষে ঐরূপ দেখিতেছি ভাবিয়া হৃদয় বারংবার চক্ষু মার্জন করিল, চতুষ্পার্শ্বস্থ পদার্থসকল নিরীক্ষণ করিয়া পুনরায় ঠাকুরের দিকে দেখিতে লাগিল কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না - বৃক্ষ, লতা, গঙ্গা, কুটির প্রভৃতি পদার্থনিচয়কে পূর্ববৎ দেখিতে পাইলেও ঠাকুরকে পুনঃপুনঃ ঐরূপ দেখিতে থাকিল! তখন বিস্মিত হইয়া হৃদয় ভাবিল, 'আমার ভিতরে কি কোনরূপ পরিবর্তন উপস্থিত হইয়াছে, যাহাতে ঐরূপ দেখিতেছি?' ঐরূপ ভাবিয়া সে আপনার দিকে চাহিবামাত্র তাহার মনে হইল সেও দিব্যদেহধারী জ্যোতির্ময় দেবানুচর সাক্ষাৎ দেবতার সঙ্গে থাকিয়া চিরকাল তাঁহার সেবা করিতেছে। মনে হইল, সে যেন ঐ দেবতার জ্যোতির্ঘন-অঙ্গসম্ভূত অংশবিশেষ, এবং তাঁহার সেবার জন্যই তাহার ভিন্ন শরীরধারণপূর্বক পৃথকভাবে অবস্থিতি। ঐরূপ দেখিয়া এবং নিজ জীবনের ঐরূপ রহস্য হৃদয়ঙ্গম করিয়া তাহার অন্তরে আনন্দের প্রবল বন্যা উপস্থিত হইল। সে আপনাকে ভুলিল, সংসার ভুলিল, পৃথিবীর মানুষ তাহাকে উন্মাদ বলিবে, সে কথা ভুলিল এবং অর্ধবাহ্যভাবাবেশে উন্মত্তের ন্যায় চিৎকার করিয়া বারংবার বলিতে লাগিল - "ও রামকৃষ্ণ, ও রামকৃষ্ণ, আমরা তো মানুষ নহি, আমরা এখানে কেন? চল দেশে দেশে যাই, জীবোদ্ধার করি! তুমি যাহা, আমিও তাহাই!"