পঞ্চম খণ্ড - তৃতীয় অধ্যায়: নরেন্দ্রনাথের প্রথম আগমন ও পরিচয়
প্রথম দর্শনে ঠাকুরের সম্বন্ধে নরেন্দ্রের ধারণা - ইনি অর্ধোন্মাদ কিন্তু ঈশ্বরার্থে যথার্থই সর্বস্বত্যাগী
"বসিয়া তাঁহাকে লক্ষ্য করিতে লাগিলাম ও ভাবিতে লাগিলাম। দেখিলাম, তাঁহার চালচলনে, কথাবার্তায় অপর সকলের সহিত আচরণে উন্মাদের মতো কিছুই নাই। তাঁহার সদালাপ ও ভাবসমাধি দেখিয়া মনে হইল সত্য সত্যই ইনি ঈশ্বরার্থে সর্বত্যাগী এবং যাহা বলিতেছেন তাহা স্বয়ং অনুষ্ঠান করিয়াছেন। 'তোমাদিগকে যেমন দেখিতেছি, তোমাদিগের সহিত যেমন কথা কহিতেছি, এইরূপে ঈশ্বরকে দেখা যায় ও তাঁহার সহিত কথা কহা যায়, কিন্তু ঐরূপ করিতে চাহে কে? লোকে স্ত্রীপুত্রের শোকে ঘটি ঘটি চক্ষের জল ফেলে, বিষয় বা টাকার জন্য ঐরূপ করে, কিন্তু ঈশ্বরকে পাইলাম না বলিয়া ঐরূপ কে করে বল? তাঁহাকে পাইলাম না বলিয়া যদি ঐরূপ ব্যাকুল হইয়া কেহ তাঁহাকে ডাকে তাহা হইলে তিনি নিশ্চয় তাহাকে দেখা দেন' - তাঁহার মুখে ঐসকল কথা শুনিয়া মনে হইল তিনি অপর ধর্মপ্রচারকসকলের ন্যায় কল্পনা বা রূপকের সহায়তা লইয়া ঐরূপ বলিতেছেন না, সত্য সত্যই সর্বস্ব ত্যাগ করিয়া এবং সম্পূর্ণ মনে ঈশ্বরকে ডাকিয়া যাহা প্রত্যক্ষ দেখিয়াছেন, তাহাই বলিতেছেন। তখন তাঁহার ইতঃপূর্বের আচরণের সহিত ঐসকল কথার সামঞ্জস্য করিতে যাইয়া এবারক্রম্বিপ্রমুখ ইংরাজ দার্শনিকগণ তাঁহাদিগের গ্রন্থমধ্যে যে-সকল অর্ধোন্মাদের (monomaniac) উল্লেখ করিয়াছেন, সেইসকল দৃষ্টান্ত মনে উদিত হইল এবং দৃঢ়নিশ্চয় করিলাম, ইনিও ঐরূপ হইয়াছেন। ঐরূপ নিশ্চয় করিয়াও কিন্তু ইঁহার ঈশ্বরার্থে অদ্ভুত ত্যাগের মহিমা ভুলিতে পারিলাম না। নির্বাক হইয়া ভাবিতে লাগিলাম, উন্মাদ হইলেও এ ব্যক্তি মহাপবিত্র, মহাত্যাগী এবং ঐজন্য মানবহৃদয়ের শ্রদ্ধা, পূজা ও সম্মান পাইবার যথার্থ অধিকারী! ঐরূপ ভাবিতে ভাবিতে সেদিন তাঁহার চরণবন্দনা ও তাঁহার নিকটে বিদায় গ্রহণপূর্বক কলিকাতায় ফিরিয়া আসিলাম।"
যাঁহাকে দেখিয়াই ঠাকুরের মনে ঐরূপ অদৃষ্টপূর্ব ভাবের উদয় হইয়াছিল তাঁহার পূর্বকথা পাঠকের জানিবার স্বতই কৌতূহল হইবে, এজন্য আমরা এখন সংক্ষেপে উহার আলোচনায় প্রবৃত্ত হইতেছি।