Prev | Up | Next

পঞ্চম খণ্ড - তৃতীয় অধ্যায়: নরেন্দ্রনাথের প্রথম আগমন ও পরিচয়

নরেন্দ্রের প্রথম ধ্যানতন্ময়তা - রায়পুর যাইবার পথে

নরেন্দ্রনাথের পিতা এক সময়ে বিষয়কর্মোপলক্ষে মধ্যপ্রদেশের রায়পুর নামক স্থানে কিছুকাল অবস্থান করিয়াছিলেন। অধিক কাল তথায় থাকিতে হইবে বুঝিয়া নিজ পরিবারবর্গকে তিনি কিছুকাল পরে ঐ স্থানে আনাইয়া লইয়াছিলেন। তাঁহাদিগকে লইয়া যাইবার ভার ঐ কালে নরেন্দ্রনাথের উপরই অর্পিত হইয়াছিল। নরেন্দ্রের বয়স তখন চৌদ্দ-পনের বৎসর মাত্র ছিল। ভারতের মধ্যপ্রদেশে তখন রেল হয় নাই, সুতরাং রায়পুর যাইতে হইলে শ্বাপদসঙ্কুল নিবিড় অরণ্যের মধ্য দিয়া একপক্ষেরও অধিক কাল গো-যানে করিয়া যাইতে হইত। ঐরূপে অশেষ শারীরিক কষ্টভোগ করিতে হইলেও নরেন্দ্রনাথ বলিতেন, বনস্থলীর অপূর্ব সৌন্দর্য-দর্শনে উক্ত কষ্টকে কষ্ট বলিয়াই তাঁহার মনে হয় নাই এবং অযাচিত হইয়াও যিনি ধরিত্রীকে ঐরূপ অনুপম বেশভূষায় সাজাইয়া রাখিয়াছেন, তাঁহার অসীম শক্তি ও অনন্ত প্রেমের সাক্ষাৎ পরিচয় প্রথম প্রাপ্ত হইয়া তাঁহার হৃদয় মুগ্ধ হইয়াছিল। তিনি বলিতেন, "বনমধ্যগত পথ দিয়া যাইতে যাইতে ঐ কালে যাহা দেখিয়াছি ও অনুভব করিয়াছি, তাহা স্মৃতি-পত্রে চিরকালের জন্য দৃঢ়মুদ্রিত হইয়া গিয়াছে, বিশেষতঃ একদিনের কথা। উন্নতশীর্ষ বিন্ধ্যগিরির পাদদেশ দিয়া সেদিন আমাদিগকে যাইতে হইয়াছিল। পথের দুই পার্শ্বেই গিরিশৃঙ্গসকল গগন স্পর্শ করিয়া দণ্ডায়মান; নানাজাতীয় বৃক্ষ-লতা ফল-পুষ্প-সম্ভারে অবনত হইয়া পর্বত-পৃষ্ঠের অপূর্ব শোভা সম্পাদন করিয়া রহিয়াছে; মধুর কাকলিতে দিক পূর্ণ করিয়া নানা বর্ণের বিহগকুল কুঞ্জ হইতে কুঞ্জান্তরে গমন অথবা আহার-অন্বেষণে কখনও কখনও ভূমিতে অবতরণ করিতেছে, - ঐসকল বিষয় দেখিতে দেখিতে মনে একটা অপূর্ব শান্তি অনুভব করিতেছিলাম। ধীর-মন্থর গতিতে চলিতে চলিতে গো-যানসকল ক্রমে ক্রমে এমন একস্থলে উপস্থিত হইল যেখানে পর্বতশৃঙ্গদ্বয় যেন প্রেমে অগ্রসর হইয়া বনপথকে এককালে স্পর্শ করিয়া রহিয়াছে। তখন তাহাদিগের পৃষ্ঠদেশ বিশেষভাবে নিরীক্ষণ করিয়া দেখি, একপার্শ্বের পর্বতগাত্রে মস্তক হইতে পাদদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত একটি সুবৃহৎ ফাট রহিয়াছে এবং ঐ অন্তরালকে পূর্ণ করিয়া মক্ষিকাকুলের যুগযুগান্তর পরিশ্রমের নিদর্শন-স্বরূপ একখানি প্রকাণ্ড মধুচক্র লম্বিত রহিয়াছে! তখন বিস্ময়ে মগ্ন হইয়া সেই মক্ষিকা-রাজ্যের আদি-অন্তের কথা ভাবিতে ভাবিতে মন ত্রিজগৎ-নিয়ন্তা ঈশ্বরের অনন্ত শক্তির উপলব্ধিতে এমনভাবে তলাইয়া গেল যে, কিছুকালের নিমিত্ত বাহ্য সংজ্ঞার এককালে লোপ হইল। কতক্ষণ ঐভাবে গো-যানে পড়িয়াছিলাম, স্মরণ হয় না। যখন পুনরায় চেতনা হইল তখন দেখিলাম, উক্ত স্থান অতিক্রম করিয়া অনেক দূরে আসিয়া পড়িয়াছি। গো-যানে একাকী ছিলাম বলিয়া ঐ কথা কেহ জানিতে পারে নাই।" প্রবল কল্পনাসহায়ে ধ্যানের রাজ্যে আরূঢ় হইয়া এককালে তন্ময় হইয়া যাওয়া নরেন্দ্রনাথের জীবনে বোধ হয় ইহাই প্রথম।

Prev | Up | Next


Go to top