দ্বিতীয় খণ্ড - গুরুমাতা-বন্দনা
১
জয় জয় শ্রীশ্রীমাতা জগতজননী।
গুণময়ী গুণাতীত ব্রহ্ম সনাতনী॥
অখণ্ডা অরূপা তুমি তুমি নিরুপমা।
পুরুষ প্রকৃতি তুমি তুমি মা প্রধানা॥
সৃষ্টির অঙ্কুর তুমি সকলের মূল।
তুমি মা চব্বিশ তত্ত্ব তুমি সূক্ষ্ম স্থূল॥
তোমার ইচ্ছায় সৃষ্টি স্থিতিতে পালন।
পুনঃ রাখ কোলে ল'য়ে করিয়া নিধন॥
খেলার ডালি মা তোমার গোটা সৃষ্টিখানি।
লীলাময়ী লীলাপরা লীলাস্বরূপিণী॥
একা তুমি অদ্বিতীয়া আপন মায়ায়।
ধরিয়াছ বহুরূপ জগৎ লীলায়॥
আপনার অখণ্ডতা করি খণ্ড খণ্ড।
গঠেছ অগণ্য 'আমি' রচিতে ব্রহ্মাণ্ড॥
গুপ্তভাবে আপ্তলীলা কর গো জননী।
মায়ায় তোমার জীবে করে 'আমি আমি'॥
মা তোমার নরলীলা লীলাশ্রেষ্ঠ গণি।
অযোধ্যায় সীতারূপে জনকনন্দিনী॥
রামময় প্রাণ-ভাব প্রাণের আরাম।
মন প্রাণ ধ্যান জ্ঞান দূর্বাদলশ্যাম॥
আগোটা জনম দুঃখ সহিলে পরাণে।
জনম-দুঃখিনী সীতা পুরাণে বাখানে॥
বৃন্দাবনে রাইরূপে কৃষ্ণ-পাগলিনী।
শুদ্ধসত্ত্বে তনু মহাভাব-স্বরূপিণী॥
উমারূপে হিমালয়ে নগেন্দ্রনন্দিনী।
করিলে কৈলাসে বাস হইয়া ঈশানী॥
জগত-জননীরূপে এখন লীলায়।
পূর্ণিত অন্তরাধার স্নেহ-করুণায়॥
মহামন্ত্র মা প্রণব করি উচ্চারণ।
পদতলে নতশিরে পরশে চরণ॥
জানে না সে কি পাইল ভক্তি নিরমল।
কোটি কোটি জনমের সাধনার ফল॥
মা তোমার ধরা মায়া দাও সরাইয়ে।
দেখি মা অভয়পদ নয়ন ভরিয়ে॥
করি চিত্র লীলাপট মনে বড় সাধ।
মায়া যেন পথে নাহি ঘটায় প্রমাদ॥
তুয়া পদ-প্রদর্শিকা তুমি গো জননী।
হৃদয়ে আসিয়া ঊর কণ্ঠে বস তুমি॥
দাও খুলে তালা-আঁটা হৃদয়ের দ্বার।
উঠুক রাগের বায়ু প্রসাদে তোমার॥
পঞ্চমবর্ষীয়া এবে ব্রাহ্মণের বালা।
মায়িক বালিকাবৎ করে ধূলাখেলা॥
মানুষের মত ঠিক গঠন-প্রণালী।
মায়া-বিমোহিত মত নহে কার্যগুলি॥
যে হও সে হও মাগো বিচারে কি কাজ।
অভয় চরণ যেন জাগে হৃদি-মাঝ॥
মা হ'য়ে মা থাক তুমি করি নিবেদন।
শ্রীপ্রভুর লীলারসে করি নিমগন॥
এক মর্মভেদী দুঃখ বড় বাজে প্রাণে।
কেন এত দুঃখ হেন মাতা বিদ্যমানে॥
স্মরিলে দুঃখের কথা ফেটে যায় ছাতি।
সিংহের শাবক খাই শিয়ালের লাথি॥
কি বল কি বল গো মা সহিতে কি পারি।
বিশ্বেশ্বর প্রভুদেব তুমি বিশ্বেশ্বরী॥
নিরখি যখন মাগো চরণ-কমলে।
অতি তুচ্ছ স্বর্গ ধরা ধরাতলে॥
যখন হৃদয়ে জাগে চরণ দুখানি।
ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশেরে তৃণত্রয় গণি॥
ইঙ্গিতে জননী যদি তব আজ্ঞা পাই।
উত্তরের হিমাচল দক্ষিণে বসাই॥
ভূতলে থাকিয়া ধরি গগনের চন্দ্র।
হনুর সঙ্গেতে পারি করিবারে দ্বন্দ্ব॥
সকৃষ্ণ অর্জুন-রথ ফিরাইতে পারি।
অখণ্ড ব্রহ্মাণ্ড গোটা তোলপাড় করি॥
এদিকে করুণাময়ী ওদিকে আবার।
পাষাণ হইতে শক্ত অন্তর তোমার॥
আত্মপর নাই ভেদ অপরূপ কথা।
মা হয়ে মা কাট তুমি সন্তানের মাথা॥
স্মরিলে তরাস আসে গণেশ-কাহিনী।
লোকে বলে মাথা তার উড়াইল শনি॥
শনির কি সাধ্য আসে তাহার নিকটে।
মা তুমি না দিলে সায় কেবা মাথা কাটে॥
মা তুমি মারিলে কার সাধ্য করে ত্রাণ।
তুমি মা কুপিলে নাই কাহারও এড়ান॥
যে কালে হইল দক্ষ পিতা মা তোমার।
তাঁর সনে কৈলে মা গো কিবা ব্যবহার॥
ভূতে ডেকে মাথা কেটে পাড়াইলে ভূঁয়ে।
মায়ের কি হবে কিছু না দেখিলে চেয়ে॥
অমুণ্ড করিয়া তবু তুষ্টি নাই মনে।
লোক-হাসি ছাগমুণ্ড দিলে গরদানে॥
ভকতে যতেক দয়া তাও ভাল জানি।
লঙ্কা-রক্ষিকার বেশে যখন মা তুমি॥
দশানন আজীবন তপিল কিমতি।
তাই কেহ না রহিল বংশে দিতে বাতি॥
এবে গুপ্ত অবতার এই অনুমানি।
তাই কি এতেক কহ সহিতে জননী॥
জপে তপে যোগী যারে না পায় ধেয়ানে।
সেই মাতা তুমি মা গো আঁখি বিদ্যমানে॥
সম্মুখে পেয়েছি এবে সব দুঃখ কব।
মার ছেলে কেন কহ এতেক সহিব॥
দেখি অসংসারিগণে অতিশয় টান।
গৃহীরা কি বানে-ভাসা পরের সন্তান॥
তুমি তো করেছ গৃহী দিয়া মায়া-ঠুলি।
ঘুরাতেছ ঘানিগাছে খাওয়ায়ে বিচালি।
ছুটে ছুটে মরি খেটে পেটে নাহি ভাত।
তাহার উপরে মা তোমার কশাঘাত॥
কি বিচার মা তোমার বুঝিবারে নারি।
কোন ছেলে কোলে কেহ ভূমে গড়াগড়ি॥
মায়ের নিকট হেন শোভা নাহি পায়।
এরূপ কোথায় করে কোনদেশী মায়॥
অমাতার ব্যবহার দেখে কত সই।
কবে দিনু মুখুয্যের পাকা ধানে মই॥
ইচ্ছাময়ী মাতা তুমি জগৎ-পালিকা।
নমো নমো শ্যামা-সুতা ব্রাহ্মণ-বালিকা॥
এক নিবেদন মম চরণযুগলে।
যত দুঃখ হোক যেন মন নাহি টলে॥
নালিশ মায়ের কাছে যদি মারে মায়।
ছাওয়াল নিকটে কাঁদে অন্যত্রে না যায়॥
তেমতি থাকিব মাগো এই ভিক্ষা চাই।
মা বলিয়া কাছে যেন কাঁদিয়া বেড়াই॥
কি সুন্দর নরলীলা যাই বলিহারি।
হৃদয়ে উদয় যাহা আঁকিতে না পারি॥
সাধ্যাতীত যদ্যপিহ প্রাণ নাহি মানে।
সতত প্রমত্ত মন লীলা-আন্দোলনে॥
মায়ের সহিত হৃদে ঊরহ ঠাকুর।
যেতে পথে বাধাবিঘ্ন সব করি দূর॥