দ্বিতীয় খণ্ড - অনুরাগে কালীদর্শন
১৫
জ্যেষ্ঠ খুল্লতাত-ভাই হলধারী দাদা।
পুরীতে পূজক চিন্তা করেন সর্বদা॥
শাস্ত্রজ্ঞ সাধক তেঁহ পণ্ডিতপ্রবর।
আড়ালে প্রভুরে লয়ে বুঝান বিস্তর॥
মা মা বলি কেন কাঁদ বালকের প্রায়।
শ্যামা মাত্র শুনা নাম কে পায় কোথায়॥
চাঁদ লাগি কাঁদে যেন শিশু অকারণ।
শ্যামার লাগিয়া দেখি তোমার তেমন॥
ক্ষুধা-নিদ্রা নাই কেন কাঁদ দিনে-রেতে।
পাবার হইলে শ্যামা এতদিনে পেতে॥
কেঁদ না কাঁদিলে কিবা হবে অনিবার।
কেমনে হইল হেন মাথার বিকার॥
এত বলি দাদা যত করেন সান্ত্বনা।
ততই প্রভুর হয় শেলের যাতনা॥
শ্যামা সুদুর্লভ, শুনি ভীষণ বারতা।
শতগুণে পায় বৃদ্ধি হৃদি-ব্যাকুলতা॥
প্রবেশি অস্থির প্রাণে শ্যামার মন্দিরে।
কাতরে কহেন শ্যামা-প্রতিমা-গোচরে॥
কোথা শ্যামা, দেখা দে মা মোরে একবার।
হলধারী বলে মোর মাথার বিকার॥
যাতনায় যায় প্রায় দেহ ছাড়ি প্রাণী।
তথাপি না দেয় দেখা নিদয়া পাষাণী॥
লইয়া শ্যামার খাঁড়া প্রভু অবশেষে।
বসাইতে যান যবে নিজ গলদেশে॥
তখন সাক্ষাৎকার আইলা জননী।
বলিলেন ডাকিলেই দেখা পাবে তুমি॥
থাক আপনার ভাবে আছ যেইমত।
অচল অটল নাহি হবে বিচলিত॥
সে হইতে শ্যামাপদ যদি কোন জন।
না মিলে দুর্লভ কথা করে উচ্চারণ॥
ভগবান প্রভুদেব বিশ্বাস-আকর।
সদাবদ্ধ রাখিতেন শ্রবণ-বিবর॥
জীব-শিক্ষা-হেতু প্রভু সাধনার আগে।
দেখাইলা শ্যামা মিলে কত অনুরাগে॥
অনুরাগ কারে বলে কি তার প্রকৃতি।
সরল বুদ্ধিতে শুন রামকৃষ্ণ-পুঁথি॥
রাগাত্মিকা ভক্তি যেবা সেই অনুরাগ।
কিংবা ঈশ্বরের জন্য ষোল আনা ত্যাগ॥
একলক্ষ্য সিন্ধুমুখী স্রোতের প্রকৃতি।
উগ্রতম একটানা অতি বেগবতী॥
অচল-অটল-সম গুরু-অভিমান।
যাবতীয় দ্বন্দ্বভাব অজ্ঞিয়ান জ্ঞান॥
শারীরিক মানসিক যত সংস্কার।
বাসনা কল্পনা আদি বাহ্যিক বিকার॥
ঘৃণা লজ্জা ভয় আর জাতি কুল মান।
সকলের প্রিয় দেহ প্রাণের সমান॥
তৃণসম ভাসাইয়া লয়ে যায় বেগে।
এই ধর্ম মর্ম বুঝ বহে অনুরাগে॥
এ বেগের আতিশয্য হয় এত দূর।
শুন কি প্রভাব তার অবস্থা প্রভুর॥
হৃদয়ে বেদনা গাত্রদাহের জ্বালায়।
লুটাপুটি যান ভূমে ধূলায় কাদায়॥
কোমল গায়ের চর্ম কত যায় কাটা।
বাঁধিল মাথার চুলে দীর্ঘ দীর্ঘ জটা॥
দেহভ্রম বাহ্যহারা দেহ গোটা জড়।
চড়াই আসিয়া বসে মাথার উপর॥
আহারীয়-অন্বেষণে চঞ্চু বিলিখনা।
যদ্যপি জটায় পায় তণ্ডুলের কণা॥
বুঝ অনুরাগ কিবা লক্ষণ কি তার।
পরিপক্বে ধরে মহাভাবের আকার॥
ব্যাস শ্রীরাধার অঙ্গে পুরাণে বাখানে।
দুর্লভ উদয় নহে যেখানে সেখানে॥
বিনা ষোল আনা শুদ্ধ সত্ত্বের আধার।
ভৌতিক আধারে বেগ নহে ধরিবার॥
অবতার সেইখানে মহাভাব যেথা।
জয় প্রভু রামকৃষ্ণ ভাবের বিধাতা॥