দ্বিতীয় খণ্ড - অনুরাগে কালীদর্শন
১৮
যেকোন অবস্থাপন্ন নাহি যায় বাদ।
শ্রীপ্রভু করেন পূর্ণ সকলের সাধ॥
হালী যোত্রাপন্ন যারা বাসেতে বসতি।
কায়দা করিয়া ঘরে রাখে কুলবতী॥
আসিতে না পায় শ্রীপ্রভুর দরশনে।
ভিতরে গুমুরে মরে মরম-বেদনে॥
পিঞ্জরেতে সীমাবদ্ধ বিহগীর প্রায়।
বাড়ির বাহির কভু হইতে না পায়॥
মধুর কাহিনী কথা শুন একমনে।
বাঞ্ছা পূর্ণ তাহাদের হইল কেমনে॥
তন্তুবায় জাতি এই গ্রামে এক ঘর।
যোত্রাপন্ন লোকে-জনে করে সমাদর॥
সদর অন্দর দুই তিন প্রস্থ বাড়ি।
আদবকায়দাবান পুরুষের ভারী॥
কুলবতীগণে সব থাকে অন্তঃপুরে।
উপায়বিহীনা আসে বাড়ির বাহিরে॥
বধূরা প্রভুর কথা শুনে মাত্র কানে।
উগ্রতর প্রাণে সাধ প্রভু-দরশনে॥
অনুপায়হেতু দুঃখ প্রবল অন্তরে।
ঠাকুর গদাই শুন কি করিলা পরে॥
একদিন কর্তৃপক্ষ যুবকের দলে।
হাসিয়া হাসিয়া কন উপহাস-ছলে॥
কে কেমন কৈলে বিয়ে দেখিতে না পাই।
উপায় অবশ্য কিছু করিবে গদাই॥
শুন কিবা করিলেন প্রভু গদাধর।
প্ৰতিবাসীদের সনে কৌতুক সুন্দর॥
সপ্তাহে দুবার হাট বসে এই গ্রামে।
খরিদ-বিক্রয়-কাজে বহু লোক জমে॥
একদিন হাট-দিনে রমণীর বেশে।
সন্ধ্যায় হাজির সেই তাঁতির আবাসে॥
দুহাতে পাঁইছা পরা লালপেড়ে শাড়ি।
আকণ্ঠ ঘোমটা লম্বা গতি ধীরি ধীরি॥
ধরিলে প্রকৃতিবেশ সাধ্য কার ধরে।
সদর হইয়া পার পশিলা অন্দরে॥
যেখানে অনেকগুলি ধানের মরাই।
তার পাশে ছদ্মবেশে ঠাকুর গদাই॥
আঁধারে দণ্ডায়মান যেন অনাথিনী।
বাসে বেশ-আচ্ছাদন শ্রীবয়ানখানি॥
কুলবধূ সকলেই সন্নিকট হ'য়ে।
কে তুমি কোথায় ঘর কি জেতের মেয়ে॥
একে একে জিজ্ঞাসিল প্রভু গদাধরে।
সতর্কে কহেন কথা শ্রীপ্রভু উত্তরে॥
ফিরায়ে বদনখানি যেন লজ্জা কত।
তেলীদের মেয়ে আমি বেচিবারে সুত॥
আসিয়াছিলাম হাটে সঙ্গীদের সনে।
পাছু রাখি মোরে তারা গিয়াছে ভবনে॥
একাকিনী ঘরে যাই হেন শক্তি নাই।
সন্ধ্যা তাহে তোমাদের ঘরে এনু তাই॥
বেশ বেশ বলিয়া বধূরা সমাদরে।
গুড় মুড়ি জল দিল খাইবার তরে॥
বধূগণে প্রভুদেব ধীরে ধীরে কয়।
পূর্ণোদর নাহি মোটে ক্ষুধার উদয়॥
খাইবার আবশ্যক কিছুমাত্র নাই।
রাত্রিতে আশ্রয়-স্থান এই মাত্র চাই॥
এত বলি বসিলেন মরায়ের ধারে।
বধূগণ তুষ্টমনে বসে গিয়ে ঘেরে॥
স্ত্রীলোকের রীতি যেন নানা কথা কয়।
কথোপকথনে প্রায় রাত্রি দণ্ড ছয়॥
প্রভুর মিঠানী বাক্যে এত গেছে ভুলে।
মনে নাই ঘুমায় শয্যায় শিশু ছেলে॥
ব'য়ে গেছে পানের সময় বহুক্ষণ।
ক্ষুধার জ্বালায় করে জাগিয়া রোদন॥
তখন স্মরণ হয় ছাওয়াল কুমারে।
চমকিয়া দ্রুতগতি ছুটে ঢুকে ঘরে॥
মায়ে ল'য়ে কোলে ছেলে ক্ষুধায় আতুর।
দুগ্ধপাত্রসহ কাছে বসিল প্রভুর॥
শশব্যস্ত প্রভুদেব প্রসারিয়া কর।
লইলেন শিশু ছেলে কোলের উপর॥
সোহাগে মায়ের মত গঁদলে গঁদলে।
উদর ভরিয়া দুধ খাওয়ান ছাওয়ালে॥
প্রভুর কোলেতে শিশু দুগ্ধ করে পান।
কেবা মহাভাগ্যধর না পেনু সন্ধান॥
জননী তাহার সমতুল্য ভাগ্যবতী।
প্রহর ছাড়িয়া ক্রমে ঊর্ধ্বে উঠে রাতি॥
সময় বুঝিয়া তবে বধূ যায় চ'লে।
রাত্রির ভোজনে ভাত বাড়িতে হেঁশেলে॥
দেখেন শ্রীপ্রভু মুখে মৃদুমন্দ হাস।
হেনকালে ঘরে পড়ে তাঁহার তল্লাস॥
খাবার সময় তাই ব্যাকুল অন্তর।
প্রতি ঘরে ঘরে খুঁজে দাদা রামেশ্বর॥
কোনমতে কোথাও না মিলে অন্বেষণ।
উপনীত শেষে সেই তাঁতির ভবন॥
যার সঙ্গে হয় দেখা তাহাকেই পুছে।
কে জান গদাই কাহাদের ঘরে আছে॥
কেহই সন্ধান কিছু বলিতে না পারে।
গদাই গদাই বলি ডাকে উচ্চৈঃস্বরে॥
ছোট ভাই গদাধরে আন্তরিক টান।
সকাতর রামেশ্বর আকুল-পরাণ॥
শুনিতে পাইলা প্রভু মরায়ের ধারে।
ডাকিছেন মেজোদাদা ভাত খাইবারে॥
তথা হতে ততোধিক উচ্চরবে কন।
ওগো দাদা আমি হেথা কেন উচাটন॥
পলায়ন দ্রুতপদে যেমন উত্তর।
মহারঙ্গকর প্রভুদেব গদাধর॥
ব্যাপার পড়িয়া গেল তাঁতিদের ঘরে।
পুরুষ স্ত্রীলোক যত হেসে হেসে মরে॥
ভবন আনন্দময় রঙ্গেতে প্রভুর।
শুন রামকৃষ্ণ-লীলা শ্রুতি-সুমধুর॥