প্রথম খণ্ড - গোচারণ
৪
কোন কোন দিন মাঠে হ'ত সংকীর্তন।
নাম-নাদে হ'ত ভেদ অখণ্ড গগন॥
শিশুরূপী ভগবান শিশু সঙ্গে করে।
কতই করিলা খেলা কামারপুকুরে॥
গ্রামের পশ্চিম প্রান্তে বাঁড়ুয্যে-বাগান।
সেইখানে ছিল তাঁর গোচারণ-স্থান॥
অতি মনোরম স্থল মাঠের মাঝারে।
শিয়রে ভূতির খাল বয় ধীরে ধীরে॥
গ্রামের অনতিদূর বড়ই নির্জন।
ছোট ছোট আম-গাছে বাগিচা শোভন॥
কাণ্ড-শাখা বক্রভাবে ঝোলা এত নীচে।
অল্পবয়ঃ সেও পারে উঠিবারে গাছে॥
বালক সসঙ্গ প্রভু বালক যেমন।
ছোট ছোট আম-গাছ বাগানে তেমন॥
মহাভাগ্যবান সেই বাঁড়ুয্যে-সন্তান।
বাল্য-লীলাস্থলী ছিল যাঁহার বাগান॥
প্রভু খেলিবেন যেন আগে হ'তে জানি।
বাগান করিয়াছিল বাগানের স্বামী॥
কেবা এ বাঁড়ুয্যে যেবা করিল বাগান।
শুন মন প্রভু তাঁয় কত কৃপাবান॥
শ্রীমানিক নাম ভুরসুবা গ্রামে ঘর।
কামারপুকুর হ'তে অনতি অন্তর॥
ধনাঢ্য তালুকদার উদার-প্রকৃতি।
অতিথি-সেবনে ছিল বড়ই পিরীতি॥
ভগবৎপদে তাঁর ছিল অতি মন।
প্রশান্ত-উদার-চিত্ত দারিদ্র্য-মোচন॥
পরহিতে সদা রত পর-উপকারী।
জীবন-যাপন-মাত্র এই কর্ম করি॥
বিষয়ে তাঁহার যত জনমিত আয়।
অতিথি-বৈষ্ণব-সেবা-কার্যে সব যায়॥
হরিপদলুব্ধচিত মহামতিমান।
মানিক বাঁড়ুয্যে এই তাঁহার বাগান॥
বাল্য-লীলাস্থলী হবে বুঝি সমাচার।
রচিয়া বাগান কৈল দেহ পরিহার॥
প্রভুর কৃপার পাত্র বাঁড়ুয্যেতনয়।
শুন মন ক্রমে ক্রমে কহি পরিচয়॥
বাল্য-লীলা যে সময় কামারপুকুরে।
কিছু আগে মানিক গিয়াছে দেহ ছেড়ে॥
কেহ কয় তখন আছিল দেহ তাঁর।
বলিতে নারিনু কিবা সত্য সমাচার॥
পরে তাঁর সহোদর উত্তরাধিকারী।
যেমন অগ্রজ তাঁর ধর্মে মন ভারী॥
পরিবার যত তাঁর গড়া এক ছাঁচে।
সবে ভক্ত, তর তম সাধ্য কার কাছে॥
মানিকের বংশে যত মানিক সবাই।
বারে বারে যাঁর ঘরে গেলেন গদাই॥
বড়ই শৈশব যবে জনকের সনে।
রগড় করিয়া যান মানিক-ভবনে॥
মানিকের ঘরে যত রমণী সকলে।
অতিশয় আনন্দিত গদায়ে দেখিলে॥
পরম সুন্দর শিশু লম্বমান বেণী।
ঝাঁপা দিয়া সাজাতেন আই ঠাকুরানী॥
কোমরেতে আঁটা গোট বালা দুই হাতে।
রঙিন-বসন-পরা সুন্দর দেখিতে॥
অপরূপ খেলে রূপ শ্রীবদন-মাঝে।
চলিতে বেণীতে বদ্ধ ঝুরি-ঝাঁপা বাজে॥
অমিয় বরষি বাক্য ক্ষরে আধা আধা।
রসনার স্বভাবতঃ জড়তায় বাঁধা॥
কিবা সুধা ধরে সুধা মিষ্টতার গুণ।
শিশুবাণী শুনে লাগে তিক্ত শতগুণ॥
শ্রবণ-বিমুগ্ধ বাক্য শিশুর বদনে।
মুগ্ধচিত সেই তত যেই যত শুনে॥
অন্তঃপুরবাসিনীরা সবে করে কোলে।
অপার আহ্লাদ হৃদে স্রোত বহি চলে॥
প্রভুর জনকে কহে যত নারীগণ।
তোমার তনয়ে নাই মানব-লক্ষণ॥
ভক্তিমতী মানিক-গৃহিণী একবার।
গড়ায় মনের মত কত অলঙ্কার॥
অন্তঃপুরে গদাধরে দেয় সাজাইয়ে।
একত্তরে তাহাদের যত সব মেয়ে॥
গদাধরে মুগ্ধমন এত সবাকার।
না দেখিলে কিছুদিন দেখিত আঁধার॥
লোক পাঠাইয়া দিত কামারপুকুরে।
আদরের গদাধর আনিবারে ঘরে॥
নানাবিধ খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুত করিয়া।
প্রভুর বদনে দিত গদ্গদ হৈয়া॥
কখন মিষ্টান্ন হাতে প্রত্যেক রমণী।
গদাধরে বলিতেন কার লবে তুমি॥
শিশুমতি গদাধর করি লম্ফ দান।
হাতে করি সকলের মিষ্টি কাড়ি খান॥
শুনিয়াছি ব্রজভূমে গোষ্ঠগোচারণে।
ক্ষুধার্ত রাখালবৃন্দ হয় এক দিনে॥
বিশুষ্ক-বদন কহে কানাইর ঠাঁই।
ক্ষুধায় কাতর প্রাণ কি খাইব ভাই।
তুমি রাখালের রাজা সম্বল সহায়।
বিজন বিপিনে বাঁচি করহ উপায়॥
শুনি বাণী কানু পাঠাইল সবাকারে।
ব্রাহ্মণগণের যজ্ঞে অন্ন মাগিবারে॥
অবজ্ঞা করিয়া ব্রাহ্মণেরা নাহি দিল।
দেখিয়া ব্রাহ্মণীগণ ব্যাকুলা হইল॥
থালে থালে ল'য়ে অন্ন লুকাইয়া চলে।
বিরাজে কানাই যথা বেষ্টিত গোপালে॥
ব্রাহ্মণীগণের অনুরাগে ভরা দেখি।
কানাই কহিলা যত সঙ্গিগণে ডাকি॥
এস ভাই ওই অন্ন খাইব মিলিয়া।
এত বলি থাল লয় কাড়িয়া কাড়িয়া॥
আনন্দে ভোজন দেখে যতেক রমণী।
ইহারা নিশ্চয় বটে সে সব ব্রাহ্মণী॥
মানিক-আগার সত্য মানিক-আগার।
পদরজ সবাকার মাগি বার বার॥
দয়া কর প্রভুপদে রহে যেন মতি।
যত দিন বাঁচি লিখি রামকৃষ্ণ-পুঁথি॥
লীলা-গীতি লিখিবারে বাসনা প্রবল।
তোমাদের কৃপাকণা কেবল সম্বল॥