Prev | Up | Next

দ্বিতীয় খণ্ড - পুরী-প্রবেশ এবং রানী ও মথুরের সঙ্গে পরিচয়

সুকৌশলী যাদুকর প্রভু-নারায়ণ।
কেমনে করেন ভক্ত-মন-আকর্ষণ॥
অলক্ষ্যেতে লীলার পত্তন সমুদয়।
ক্রমে ক্রমে শুন মন কহি পরিচয়॥
প্রভুর বিচিত্র খেলা কহনে না যায়।
এবে বারশ-বাষট্টি সাল গণনায়॥
শ্রীপ্রভুর বয়ঃ মাত্র উনিশ বৎসর।
একদিন শুভক্ষণে পুরীর ভিতর॥
মহাভক্ত শ্রীমথুর নেহারিয়া তাঁরে।
পরিচয় জিজ্ঞাসিল শ্রীরামকুমারে॥
কে নবীন ব্রহ্মচারী বয়ঃ সুকুমার।
উত্তরে বলিলা তেঁহ, অনুজ আমার॥
মথুর বলিল মূর্তি প্রীতি-দরশন।
পুরীমধ্যে রাখিবারে বড় লয় মন॥
পুনশ্চ কহিলা তাঁয় শ্রীরামকুমার।
এখানে থাকিতে নাহি করিবে স্বীকার॥
আর না বলিল কিছু মথুর সে দিন।
কিন্তু মনে জাগে মুগ্ধ মূরতি নবীন॥
আকৃষ্ট মথুর মন টানে থেকে থেকে।
মহা আকর্ষণী প্রভু-চরণ-চুম্বকে॥
এমন সময় জুটে আসে সেইখানে।
বিধির ঘটনা কিবা হৃদয় ভাগিনে॥
অতি প্রিয় আত্মীয়স্বজন শ্রীপ্রভুর।
ধরাধামে ভাগ্যবান হৃদয় ঠাকুর॥
হৃদয়ে পাইয়া নাহি প্রীতি-সীমা তাঁর।
দুইজনে একসঙ্গে আহার-বিহার॥
বাল্যাবধি শ্রীপ্রভুর ভালরূপে জানা।
মাটিতে গড়িতে দেব-দেবীর প্রতিমা॥
রঙে-ঢঙে এতদূর মূর্তি অবিকল।
মৃন্ময় কে বলে যেন জীবন্ত সকল॥
শিল্পকর কারিকর প্রভুর মতন।
শ্রবণে না শুনি চক্ষে নহে দরশন॥
আপনার পূজার কারণ পরমেশ।
যতনে গড়িলা গঙ্গা-মাটির মহেশ॥
ত্রিশূল-ডমরু-আদি নাগ-আভরণ।
শশী ফোঁটা শিরে জটা বলদ বাহন॥
ত্রিলোক-বিজয়ী বৃষ গড়া হেন ঠামে।
হইলেও মুক্ত আঁখি দেখে পড়ে ভ্রমে॥
ভ্রমিতে ভ্রমিতে পুরীমধ্যে শ্রীমথুর।
অবাক হইল দেখি, কীর্তি শ্রীপ্রভুর॥
মাটির বানানো শিব সঠিকের প্রায়।
কৈলাস হইতে যেন উদয় ধরায়॥
কি দিয়া গড়িলা প্রভু কি দিলা ভিতরে।
কি হেরিয়া দর্শকের মনপ্রাণ হরে॥
কি দেখিল দরশক বলিব কেমনে।
আঁখি মুদি দেখ মন হৃদয়-দর্পণে॥
ভক্ত-মন-হর প্রভু কৌশলী অপার।
নর-বুদ্ধি দিয়া তাঁর কার্য বুঝা ভার॥
লইয়া মৃন্ময় মূর্তি মথুর আপনি।
দ্রুত উতরিল যথা রানী রাসমণি॥
পুলকে পূর্ণিত হৃদে বিস্ময়ের ভার।
কহে কারিকর যেন সমকক্ষ তাঁর॥
ভুবন-মাঝার কোথা আছে বিদ্যমান।
কে তিনি গঠন যাঁর মূরতি সুঠাম॥
ভাগ্যবলে কারিকর পুরীর ভিতর।
শ্যামার পূজারী যিনি তাঁর সহোদর॥
নবীন বয়েস, বেশ ব্রহ্মচারী-প্রায়।
দরশনে মন-প্রাণ মুগ্ধ হয়ে যায়॥
মনে লয় তাঁয় যদি কালীর সেবনে।
পুরীমধ্যে রাখা যায় অতি অল্প দিনে॥
জাগরিত করিতে পারেন শ্যামা মায়ে।
এমত প্রতীত হয় তাঁহারে দেখিয়ে॥
প্রভুর নির্মিত শিব-বৃষ-দরশনে।
উঠে মথুরের ভক্তি প্রভুর চরণে॥
তাড়াতাড়ি বাহিরে আসিয়া শ্রীমথুর।
দেখিলা অদূরে সহ হৃদয় ঠাকুর॥
ভ্রমিছেন প্রভুদেব আপনার মনে।
পরস্পর নানা কথা প্রশস্ত উঠানে॥
লোক দিয়া প্রভুস্থানে পাঠায় বারতা।
বাসনা তাঁহার সঙ্গে কহিবেন কথা॥
যাইতে না চান প্রভু মথুরের কাছে।
পুরীতে থাকিতে তাঁয় জেদ করে পাছে॥
মথুর না ছাড়ে বার্তা প্রেরে বারবার।
ততই করেন প্রভুদেব অস্বীকার॥
অবশেষে সহোদর শ্রীরামকুমারে।
করে মহা অনুরোধ লয়ে যেতে তাঁরে॥
রাখিয়া জ্যেষ্ঠের আজ্ঞা প্রভু গুণধর।
উপনীত হইলেন মথুর-গোচর॥
বরাবর সঙ্গে আছে ভাগিনে হৃদয়।
ঠিক যেন বৃক্ষের পশ্চাতে ছায়া রয়॥
ভক্তবর শ্রীমথুর প্রভুরে দেখিয়া।
উঠিলেন আপনার আসন ত্যজিয়া॥
সংগোপনে লইয়া কহেন ভক্তিভরে।
পুরীতে পূজার কার্যে মত করিবারে॥
শ্রীপ্রভু বলেন তুমি ইহা বল কিবা।
এ বড় জঞ্জাল করা ঠাকুরের সেবা॥
বল কে লইবে হেপাজত নিরবধি।
ঠাকুরের মূল্যবান সেবার দ্রব্যাদি॥
তবে যদি হৃদু সঙ্গে থাকয়ে আমার।
যতই না হোক কষ্ট করিব স্বীকার॥
যে আজ্ঞা বলিয়া হৃদে আনন্দ প্রচুর।
হৃদয়ে রাখিতে মত করিল মথুর॥
স্থিতিমত স্থিরতর হইবার পর।
কি হইল ইতোমধ্যে শুনহ খবর॥
সৃষ্টিছাড়া হীনদৃষ্টি ধরে যেই জন।
সে কহিবে এ সকল সামান্য কথন॥
বাহ্য চোখে যে দেখিবে সে দেখিবে বাঁকা।
আঁখি খুলে দেখা নয় আঁখি মুদে দেখা॥
সামান্য তরঙ্গখেলা উপরে উপরে।
ধন-রত্ন-মণি-খনি জলের ভিতরে॥
তুষ যেন তুচ্ছ বস্তু নাহি তার দর।
ভিতরে যা ধরে তাই জীবন-শিকড়॥
সেইরূপ সামান্য ধরিয়া নারায়ণ।
করিছেন লীলা-বৃক্ষ-বীজের রোপণ॥
একদিন পুরীমধ্যে এখানে সেখানে।
ভ্রমিছেন প্রভু রানী দেখে শুভক্ষণে॥
চমকি উঠিল প্রাণ দেখিয়া মূরতি।
দিব্যভাবাপন্ন কায় দিব্য মুখজ্যোতি॥
ব্রাহ্মণকুমার সুশ্রী ঈশদাঁখি বাঁকা।
সুন্দর লাবণ্যকান্তি অঙ্গময় লেখা॥
সুবিশাল বক্ষঃস্থল ললাট প্রশস্ত।
সুশোভন নাসা বাহু আজানুলম্বিত॥
অতি মনোহর ঠাম শোভার আগার।
দেখিয়া হইল হৃদে ভক্তির সঞ্চার॥
কেবল ভকতি নহে স্নেহ মিশামিশি।
বারে বারে যত হেরে তত হয় খুশী॥
ভক্তির আশ্চর্য খেলা শুনহ বারতা।
কেমনে ভক্তের সঙ্গে প্রাণে প্রাণে কথা॥
জীবের হৃদয়ে যাহা উপজে ভকতি।
সে ভকতি নহে তার প্রভুর সম্পত্তি॥
ভক্তির আস্পদ প্রভু বিনা কেহ নয়।
ভক্তি দিয়া ভগবান দেন পরিচয়॥
চুপে চুপে টানাটানি প্রাণের ভিতরে।
চুম্বক লোহায় যেন পরস্পর করে॥

Prev | Up | Next


Go to top