দ্বিতীয় খণ্ড - পুরী-প্রবেশ এবং রানী ও মথুরের সঙ্গে পরিচয়
২
এ সময় ঘটে এক অদ্ভুত ঘটন।
বিষ্ণুর পূজায় ব্রতী ছিল যে ব্রাহ্মণ॥
শুভদিন জন্মাষ্টমী পূজার সময়।
ভাঙিল বিষ্ণুর পদ ভীত অতিশয়॥
কানে কানে সবে শুনে পুরীর ভিতর।
অবশেষে পশে বার্তা রানীর গোচর॥
ভক্তিমতী রাসমণি মরে মহাখেদে।
বিষ্ণুর চরণভঙ্গ অশিব সংবাদে॥
হুলস্থূল পড়ে গেল পুরীর ভিতরে।
অগণন লোকজন কম্পমান ডরে॥
বিশেষে পূজারী যেবা অনাবিষ্টমতি।
পূজা বন্ধ ভগ্ন-অঙ্গে পূজা নয় রীতি॥
নূতন মূরতি তাই পূজার কারণ।
বিধি দিল আনিবারে বিধিজ্ঞ ব্রাহ্মণ॥
শুনিয়া রানীরে প্রভু কহিলেন গিয়া।
ভগ্ন-অঙ্গ মূর্তি ফেল কিসের লাগিয়া॥
বিধি বলি এ অবিধি দিল কোন্ জন।
একত্রিত করে যত বিধিজ্ঞ ব্রাহ্মণ॥
যাহা আজ্ঞা শ্রীপ্রভুর শিরোধার্য করি।
টোলে টোলে দিল বার্তা পুরী-অধিকারী॥
যথাদিনে সমাগত শাস্ত্রজ্ঞসকল।
শাস্ত্রবিধি লয়ে করে মহা কোলাহল॥
শাস্ত্রে লেখা ভগ্ন-অঙ্গে পূজা বিধি নয়।
এক মতে যত শাস্ত্রবিদ্গণে কয়॥
শুন পরে কি হইল আশ্চর্য কাহিনী।
চলিলেন প্রভু যথা রানী রাসমণি॥
কহিলেন জিজ্ঞাসিতে শাস্ত্রজ্ঞসকলে।
স্বামীর ভাঙিলে পদ কি করিতে বলে॥
শাস্ত্রের বিধান কিবা হ'লে এ ব্যাপার।
ফেলিতে সুযুক্তি কিবা যুক্তি চিকিৎসার॥
অতি সোজা সরল শ্রীবাক্য শ্রীপ্রভুর।
স্বভাবে আপুনি যেন সরল ঠাকুর॥
সরলে দয়াল ভালবাসা সরলতা।
সরলে সরল বড় রামকৃষ্ণ-কথা॥
সরলে বুঝিল রানী প্রভুর বচন।
সভায় করিল সেই প্রশ্ন উত্থাপন॥
ঘটনার সঙ্গে প্রশ্ন লাগে যে প্রকার।
বুঝিয়া পণ্ডিতগণে দেখায়ে আঁধার॥
সোজা কথা অতি মূর্খ পারে বুঝিবারে।
শুনিয়া বিধিজ্ঞদের মুণ্ডু গেল ঘুরে॥
যায় কেন মুণ্ডু ঘুরে ভেবে দেখ মন।
সরল উত্তর যেন সরল কথন॥
বিধিমতে কহি কথা ভাবে কিবা দায়।
ধীরগণ পরস্পর মুখপানে চায়॥
কাটা যায় দত্ত-বিধি শাস্ত্রসহ তার।
যদি কয় স্বামী উপযুক্ত চিকিৎসার॥
অথচ চরণভঙ্গ স্বামী দেয় ফেলে।
ধরি নর-কলেবর, কি করিয়া বলে॥
অবশেষে শাস্ত্র ছাড়ি দিতে হইল বিধি।
পীড়িত পতির সেবা যুক্তি নিরবধি॥
মীমাংসায় ভেসে যায় রানী সুখ-নীরে।
চৌগুণ বাড়িল ভক্তি প্রভুর উপরে॥
প্রভুরে জানিয়া কারিগর-শিরোমণি।
করপুটে প্রভুরে কহিল রাসমণি॥
সারিবারে ভগ্নপদ আপনার ভার।
সায় দিয়া প্রভুদেব করিলা স্বীকার॥
ভগ্নপদ সারিয়া দিলেন সেই দিনে।
কোথায় ভাঙিয়াছিল সাধ্য কার চিনে॥
অবাক হইল সবে পুরীর ভিতর।
কিবা মহা সুকৌশলী প্রভু কারিগর॥
কি বুঝ আশ্চর্য মন, কথা, কথা ছাড়া।
এ মহান্ বিশ্ব যাঁর সঙ্কেতেতে গড়া॥
হয় রয় যায় সৃষ্টি যাঁহার আজ্ঞায়।
সারিলেন ভগ্নপদ কি বিচিত্র তায়॥
তবে এবে নর-দেহ নরের মতন।
দীন-দুঃখী নিরক্ষর পরান্ন-ভোজন॥
লইয়া ব্রাহ্মণ-বেশ খেলেন আপুনি।
হর্তা কর্তা বিশ্বের বিধাতা চিন্তামণি॥
মানুষে না চিনে নর-জ্ঞানে লয় তাঁরে।
তাই লোকে অবাক করম তাঁর হেরে॥
ভিতরে অসীম শক্তি শক্তির আধার।
বাহ্যে মাত্র সাজা বেশ ফল্গুর আকার॥
সৎবুদ্ধিযুক্ত হরিলুব্ধ চক্ষুষ্মান।
স্পষ্ট দেখে খেলে তাঁহে রসের তুফান॥
তুষ্ট হয়ে ভক্ত রানী ভক্তিভরে তাঁয়।
বলিলেন থাকিবারে বিষ্ণুর সেবায়॥
ধার্য করি শ্রীপ্রভুর মাসিক বেতন।
ছোট ভট্টাচার্য আখ্যা করিল অর্পণ॥
বড় ভাই বড় ভট্টাচার্য মহাশয়।
শ্যামা-বেশকারী হ'ল ভাগিনে হৃদয়॥
গঙ্গাতীরে যেথা যত আছে দেবালয়।
তুলনায় এ পুরীর সঙ্গে কেহ নয়॥
পুরী দেখিবারে আসে কত লোকজন।
ধনী-মানী-গুণী-দুঃখী সকল রকম॥
কালী মায়ে রাধাশ্যামে যারা ধনবান।
ভক্তিভরে অর্থ দিয়া করেন প্রণাম॥
আগাগোড়া এই রীতি পুরীর ভিতরে।
পূজারীর প্রাপ্য যাহা প্রণামীতে পড়ে॥
প্রভুদেব টাকাকড়ি নাহি লন হাতে।
বলিতেন দুঃখিগণে বিলাইয়া দিতে॥
ত্যাগী অনাসক্ত প্রভু ছিলা আজীবন।
যতই প্রণামী পড়ে সব বিতরণ॥