Prev | Up | Next

দ্বিতীয় খণ্ড - পুরী-প্রবেশ এবং রানী ও মথুরের সঙ্গে পরিচয়

ছয় মাস বিষ্ণুর মন্দিরে পূজা করি।
পশ্চাৎ হইলা প্রভু শ্যামার পূজারী॥
বিষ্ণুর সেবাতে হৈল অগ্রজের ভার।
ইহাতে সন্তুষ্ট ভারি শ্রীরামকুমার॥
এইরূপে কিছুদিন গত হইলে পর।
ত্যজিলেন শ্রীরামকুমার কলেবর॥
অগ্রজের লোকান্তরে শ্রীপ্রভু এখন।
শ্যামার সেবায় দিল ষোল আনা মন॥
প্রভুর অপার কথা কে কহিবে ক'টি।
কোটি-মুখে কহিলেও তবু ত্রুটি কোটি॥
পড়ে দামামায় কাঠি আগুন রঞ্জকে।
যে হ'তে আইলা প্রভু পূজিতে শ্যামাকে॥
শ্যামায় পিরীতি বড় শ্যামা মনপ্রাণ।
তপ-জপ-তন্ত্র-মন্ত্র ধন ধ্যান-জ্ঞান॥
সুদৃশ্য রচেন বেশ প্রভু গুণধর।
দেখামাত্র দর্শকের বিমোহে অন্তর॥
নিত্যই নূতন বেশ নাহিক উপমা।
মূর্তিমতী ঠিক যেন চিৎময়ী শ্যামা॥
বিবিধ কুসুম জবা শ্রীচরণে সাজে।
অপরূপ শ্যামা-রূপ শ্রীমন্দিরমাঝে॥
উপজয়ে দিব্যভাব পাষণ্ড-অন্তরে।
একবার শ্যামা-রূপ নয়নেতে হেরে॥
ঘোষণা হইল বার্তা কথায় কথায়।
আছে বহু কালীমূর্তি এমন কোথায়॥
দলে দলে আসে লোক কত দিক হ'তে।
নিরুপমা শ্যামা-মাতা এখানে দেখিতে॥
অতিথি-সেবন-শালা পুরীর ভিতরে।
কত আসে যায় সাধু সংখ্যা কেবা করে॥
শ্যামা দেখি সর্বজনে সমস্বরে কন।
কোথাও না করি হেন মূর্তি দরশন॥
নবভাবে মাতি সবে কহে উচ্চৈঃস্বরে।
কি জানি কি আছে শ্যামা-প্রতিমা-ভিতরে॥
তড়িতের বার্তাবহ তারেতে যেমন।
দ্রুতগতি ছুটে কথা বিদ্যুৎ-মতন॥
সেরূপ সুঠাম শ্যামা প্রতিমা-কাহিনী।
পরস্পর সাধু-মুখে ছুটিল অমনি॥
অতিথি সন্ন্যাসী ভক্ত থাকে যে যেখানে।
দক্ষিণেশ্বরের কথা শুনে কানে কানে॥
সুগূঢ় প্রভুর কথা কি শকতি বলি।
প্রচারিলা নিজ স্থান সাজাইয়া কালী॥
আপনে রাখিলা গুপ্ত পূজারীর সাজে।
নাহি দিলে ধরা-ছুঁয়া সাধ্য কার বুঝে॥
গুহ্য হ'তে অতি গুহ্য তাঁহার করম।
মায়া-অন্ধ নরে কিবা বুঝিবে মরম॥
মানুষ থাকুক দূরে দেবাদির শক্ত।
কৃপায় যদ্যপি নাহি আঁখি হয় মুক্ত॥
মায়া-ছানি-মুক্ত চক্ষু নহে যতক্ষণ।
কদাচ না হয় তাঁর লীলা দরশন॥
মানুষের খোল ল'য়ে আপনি শ্রীহরি।
বিরাজেন পুরী-মধ্যে হইয়া পূজারী॥
যেখানে যখন হয় বিরাজের স্থান।
দিব্য ভাব সদা তথা থাকে বিদ্যমান॥
পুরীতে আসিয়া লোকে এত প্রীতি পায়।
সে কেবা এসেছে কোথা সব ভুলে যায়॥
নবভাব-আবির্ভাব এমন অন্তরে।
ঠাকুর-প্রসাদ পায় ভক্তি-সহকারে॥
ব্রাহ্মণেও নাহি রাখে জাতির বিচার।
শুন রামকৃষ্ণ-কথা অমৃত-ভাণ্ডার॥
ভকতবৎসল প্রভু ভক্তগত-প্রাণ।
নাহি কেহ প্রিয় তাঁর ভক্তের সমান॥
রানীর আছিল বড় হৃদয়ে বিষাদ।
উচ্চবর্ণে তুচ্ছ করে ঠাকুর-প্রসাদ॥
সে বিষাদ একেবারে করিবারে দূর।
পুরী-মধ্যে প্রবেশিলা দয়াল ঠাকুর॥
প্রসাদ আপনে পেয়ে করুণা-নিদান।
অভ্যাগত তথা যেবা তাহারে পাওয়ান॥
নিষ্ঠাচারী তাহারাও বিচার না করে।
প্রসাদ উঠায়ে খায় অতি ভক্তিভরে॥
শ্যামা-ভক্ত রাসমণি শ্যামা ভালবাসে।
দেখে শ্যামা নিরুপমা পরম হরিষে॥
কালীমাতা বিভূষিতা করি দরশন।
কত যে আনন্দ তাঁর নাহি নিরূপণ॥
বেশকারী প্রভু বেশ তাঁহার রচিত।
দেখিলেই হয় মুগ্ধ মন-প্রাণ-চিত॥
জনমে রানীর ভক্তি প্রভুর উপরে।
পরাণ-প্রতিমা শ্যামা সুসজ্জিত হেরে॥
বুঝিল প্রভুর বেশ সেবা-অনুরাগে।
পাষাণ-মূরতি শ্যামা উঠিয়াছে জেগে॥
দিন দিন ভক্তি-প্রীতি অতি বৃদ্ধি পায়।
শ্যামার সেবায় রত শ্রীপ্রভুর পায়॥
ঈশ্বর-প্রসঙ্গ কভু হয় দুইজনে।
কন প্রভু গুণধর ভক্ত রানী শুনে॥
কখন কখন মিঠা শ্যামা-গুণগান।
শুনিয়া রানীর হয় শীতল পরাণ॥
শ্যাম-শ্যামা-গুণগান প্রভুর বদনে।
কি মিঠা সে জানে যেবা শুনিয়াছে কানে॥
মধুর সুস্বর কিবা নহে বলিবার।
পিক-অলি বীণা-বেণু একত্র ঝঙ্কার॥
দিব্যভাব পরিপূর্ণ মাখান ভিতরে।
শুনিলে পাষাণ-মন দ্রবীভূত করে॥
কিবা আভা শোভা ফুল্ল বদনকমলে।
আজন্ম পাষণ্ড যেবা সেও দেখে ভুলে॥
সঙ্গীতে রানীর নেশা হৈল অতিশয়।
নিত্য নিত্য একবার না শুনিলে নয়॥
ত্রুটি নাহি সর্ব অঙ্গে পূজা সু-সুন্দর।
পূজায় সেবায় যায় প্রহর প্রহর॥
ডুবিয়া যাইত ষোল আনা মন-প্রাণ।
কিছু না থাকিত তাঁর বাহ্যিক গিয়ান॥
কেবা কিবা কয় কেবা কোথা আসে যায়।
শুনা দেখা নাই এত প্রমত্ত পূজায়॥
মধুলুব্ধ মধুপ যেমন ফুল্ল ফুলে।
মত্ত হয়ে পিয়ে মধু মন-প্রাণ ভুলে॥
উলট-পালট খায় দলের উপর।
আপনার দেহ কোথা নাহিক খবর॥
কোথা শক্তিধর পাখা সকলের মূল।
নাই গ্রাহ্য থাক যাক সুকোমল হুল॥
টান দিয়ে শুষে চুষে বিভোর নেশায়।
সেইমত প্রভুদেব শ্যামার পূজায়॥
এবে ঘোর কলিকাল যত জীবগণে।
পূজিতে ভজিতে জানে কামিনীকাঞ্চনে॥
দেবদেবী-পূজা-সেবা-আদি আরাধনা।
জপ-তপ ক্রিয়া-কর্ম সাধন-ভজনা॥
একবারে লুপ্তপ্রায় গোটা ধরাতল।
যাহা কিছু আছে মাত্র নাম সে কেবল॥
তাই প্রভু দয়াময় দয়ার সাগর।
উপনীত ধরাধামে ধরি কলেবর॥
শিক্ষা দিতে জীবগণে চিরহিতকারী।
সাধন ভজন পূজা আপনে আচরি॥
প্রভুর পূজার কথা অমৃত-ভারতী।
কেমনে করেন শুন শ্যামার আরতি॥
সুবিদিত রাসমণি তাঁর দেবালয়।
উপযুক্তমত বাদ্য আরতি-সময়॥
খোল-করতাল-বাদ্য বিষ্ণুর প্রাঙ্গণে।
বাজে জোড়া নহবত উত্তর দক্ষিণে॥
বাজে জোড়া কাঁসর দামামা-ঘড়ি বাজে।
মা মা রব উচ্চে সব গায় পুরীমাঝে॥
এখানে মন্দিরে প্রভুদেব ভগবান।
তেজস্বী তপস্বীসম বর্ণ দীপ্তিমান॥
মহাক্রমে বৃহৎ আরতি এক করে।
গুরুভার ঘণ্টা প্রভু ধরিয়া অপরে॥
আলো করি শ্রীমন্দির করেন আরতি।
দেখ মন এবে কিবা প্রভুর মূরতি॥
ভক্তগণ-মনোলোভা শোভা নিরুপম।
উপমায় কিছু নাই আঁকিতে অক্ষম॥
হয় ক্লান্তকলেবর যত বাদ্যকরে।
বাজাইতে বহুক্ষণ হাত গেল ভরে॥
শব্দ গেল স্তব্ধ সব ঘর্মে আর্দ্রকায়।
প্রভুর আরতি-ঘণ্টা তবু না ফুরায়॥
ঘোর ঘন ঘন শব্দে ঘণ্টা বেজে চলে।
হেলে দুলে আরতি দক্ষিণকরে খেলে॥
অবিরাম চলিতেছে আরতি অতুল।
বাহ্য নাহি প্রভু যেন কলের পুতুল॥
রক্তিম বরণ মুখমণ্ডলে বেড়ায়।
উচ্চরবে মা মা রব পাগলের প্রায়॥
অবশেষে জড়বৎ বাহ্য হারাইয়া।
হৃদয় বাহিরে আনে যতনে ধরিয়া॥
এইমত প্রায় হয় আরতির কালে।
না বুঝিয়া লোকে-জনে উন্মত্ততা বলে॥
দিবাভাগে বলিলাম পূজার ধরন।
সাধনা রাত্রিতে হয় শুন শুন মন॥
ভক্তভাবে অবতার প্রভু ভগবান।
কূলহারা জীবে দিতে ধর্মের বিধান॥
ভক্তভাবী ভগবান তাঁহার বারতা।
আমাদের সঙ্গে তাঁর বিপরীত কথা॥
এক ভগবান আর জীব অগণন।
জীবভাবে জীবভাবে সদা সংমিলন॥
ভক্তভাবে জীবভাবে কখন না মিলে।
তাই ক্ষেপা প্রভুদেব জীবগণে বলে॥
দেশে রাষ্ট্র হৈল কথা বড় পরমাদ।
সবে কয় হইয়াছে গদাই উন্মাদ॥
হেন পরমাদ কথা মনে হয় ডর।
ইহার ভিতরে আছে বড়ই রগড়॥
বিয়া করিবার সাধ বড় তাঁর মনে।
উন্মাদ-প্রবাদে লোকে কন্যা দিবে কেনে॥
শ্রীপ্রভুর বিবাহের সাধ অতিশয়।
মানুষে যেরূপ করে সে প্রকারে নয়॥
বালকস্বভাব প্রভু বালক-আচার।
বয়সের সঙ্গে মাত্র বাড়িছে আকার॥
বালকের ভাব খেলে বাক্যকায়মনে।
স্মরণ রাখিও কথা শয়নে স্বপনে॥
সরল মধুর বড় রামকৃষ্ণ-কথা।
বুঝিতে নারিবে যদি ভুলহ বারতা॥

Prev | Up | Next


Go to top