Prev | Up | Next

দ্বিতীয় খণ্ড - মধুরভাবে সাধনা

ভাবিয়া দেখহ মন আপনার মনে।
প্রভুর স্বরূপ কিবা প্রভু কোন্ জনে॥
কিবা নাম কিবা বস্তু কোথায় বসতি।
কোথায় আরম্ভ তাঁর কোথা তাঁর ইতি॥
কোথা গতি এইখানে কিবা প্রয়োজন।
নারায়ণ নিজে পূর্ণব্রহ্ম সনাতন॥
চিনিয়াও প্রভুদেবে নাহি গেল চেনা।
পুঁথিতে প্রভুর নাম রহিল অচেনা॥
অচেনা ঠাকুর মোর অতি অপরূপ।
তিনিই জানেন মাত্র তাঁহার স্বরূপ॥
সঙ্কট-অবস্থাপন্ন সাধনা-সময়।
ঘন ঘন অচেতন বাহ্য নাহি রয়॥
মথুর উৎকণ্ঠপ্রাণ তাহার কারণে।
পাছে ঘটে অমঙ্গল যতন-বিহনে॥
ধরা-মাঝে ধন্য ভক্ত মথুর বিশ্বাস।
করজোড়ে পদরেণু মাগে ক্রীতদাস॥
গুরুভক্তি মহারত্ন ভিক্ষা দেহ মোরে।
দণ্ডবৎ পদানত অধম কিঙ্করে॥
যত্নে রাখিবারে তাঁয় এতেক ভাবিয়া।
জানবাজারের ঘরে গেলেন লইয়া॥
সদা সচকিত থাকে সহ-পরিবারে।
বাহিরে না রাখি তাঁয় রাখিল অন্দরে॥
যেমন মথুর ভক্ত সমযোগ্য তাঁর।
ভক্তিমতী জগদম্বা ঘরে পরিবার॥
কন্যাগণ বিলক্ষণ ভক্তি ঘটে ধরে।
যেন পিতৃ-মাতৃ-রক্ত বহমান শিরে॥
সকলে সমানভাবে যত্ন করে অতি।
ভক্তের আকর ভক্ত মথুর-বসতি॥
দিনরাতি রাখে তাঁয় আঁখির উপরে।
শয্যা রচে আপনার শয়ন-আগারে॥
প্রভুরে সরম লাজ নাহি আসে কার।
স্ত্রীলোক দেখিত তাঁয় স্বজাতি তাহার॥
প্রভুরে পুরুষজ্ঞান কভু না হইত।
বর্ণে বর্ণে স্ত্রীলোকের স্বভাবে মিলিত॥
পুরুষ-আকার প্রভু পুরুষপ্রধান।
রমণী বলিয়া কেন রমণীর জ্ঞান॥
সমস্যা বুঝিতে যদি সাধ হয় মন।
বিরলে বসিয়া স্মর প্রভুর চরণ॥
ক্ষীণ হীন নর-বুদ্ধি হেয় অতিশয়।
অবিরত স্বার্থে রত কুঞ্চিত-হৃদয়॥
নীচমুখে মনোভাব দৃষ্টি অধস্তলে।
কলুষ কামনা যত শিরে শিরে খেলে॥
ইন্দ্রিয়ের বাহ্য ভোগে সংজ্ঞাহীন ঘুরে।
যেন তৃণ ঘূর্ণিপাকে নদীর ভিতরে॥
কাদা-মাখা পাঁকে মগ্ন তেজহীন মন।
তার সঙ্গে লীলা দেখা না হয় কখন॥
চাই শুদ্ধ সৎবুদ্ধি যাহার গোচর।
সত্যময় শুদ্ধময় পরম-ঈশ্বর॥
তাই বলি স্মর প্রভু সরল পরাণে।
যদি থাকে সাধ তাঁর লীলা-দরশনে॥
অদ্ভুত এ লীলাখেলা বুঝে উঠা ভার।
প্ৰকৃত রমণী প্রভু পুরুষ-আকার॥
ভিতরে ঢুকিতে মন বুদ্ধি যায় দুলে।
রমণীর ভাব ধর্মসাধনার বলে॥
কায়মনোবাক্যে খেলে ভাবধর্ম-রীতি।
কে চিনে পুরুষ প্রভু প্ৰকৃত প্রকৃতি॥
সৃষ্টিছাড়া তাঁর কর্ম কিসে নরে বুঝে।
বদলে ব্রহ্মার সৃষ্টি মহিমার তেজে॥
বিশেষিয়া বলিবারে না পারিনু মন।
কলমে আঁকিতে চিত্র অধম অক্ষম॥
অদ্ভুত সাধনা কৈলা প্রভু পরমেশ।
দিবারাতি এ সময় রমণীর বেশ॥
নারী বিনা নর-জ্ঞান নাহি আসে মনে।
ঘন ঘন বাহ্যহারা হয় এ সাধনে॥
বাহ্যহারা কারে বলে সে বা কি রকম।
শুনিলে না রয় বাহ্য অকথ্য কথন॥
শুন মন একমনে ভক্তিসহকারে।
অনর্থের মূল বাহ্য ক্রমে যাবে ছেড়ে॥
চোখে চোখে রাখে তাঁরে যত পরিবার।
একদিন শুন কিবা হইল ব্যাপার॥
উপবিষ্ট একধারে প্রভু পরমেশ।
বিভোর বিভোর অঙ্গ ভাবের আবেশ॥
বাহ্যিক চেতনহীন কেহ নাহি জানে।
অতিশয় অনাবিষ্ট ভৃত্য এক জনে॥
অগ্নিবর্ণ গুলে ভরা কলিকা লইয়া।
যাইতে যাইতে দ্রুত সেই পথ দিয়া॥
ফেলে এক পোড়া-গুল রক্তিম বরণ।
যেখানে প্রভুর পিঠ কাঁধে সংলগন॥
বারে বারে কত যে সহেন নারায়ণ।
পাপে রত ভ্রষ্ট জীব উদ্ধার কারণ॥
বিশেষতঃ আগাগোড়া কষ্ট এইবারে।
জানি না পাষাণ কেবা সৃষ্টির ভিতরে॥
নাহিক মমতা দয়া শুনিয়া সকল।
সম্বরিতে পারে চক্ষে না ফেলিয়া জল॥
মায় যেন সয় কষ্ট অকাতর-প্রাণে।
সন্তানের এক তিল মঙ্গল-সাধনে॥
সাধন-ভজনে তেন প্রভু পরমেশ।
জীবের মঙ্গল-হেতু সহিলা অশেষ॥
কষ্টে নহে পরাঙ্মুখ নহে ক্ষুণ্ণ মন।
বরঞ্চ সন্তুষ্ট কষ্টে জীবের কারণ॥
দুপুর বেলায় যেন ঘড়ির দুকাঁটা।
তেমতি তাঁর মন ব্রহ্মে সদা আঁটা॥
সমাধি হইলে মন ব্রহ্মে হয় যোগ।
সমাধির ফল ব্রহ্মানন্দ-উপভোগ॥
তুচ্ছ করি তারে কৈলা জীবের কল্যাণ।
অহেতুক কৃপাসিন্ধু প্রভু ভগবান॥
শিবময় দয়াময় মঙ্গলস্বরূপ।
জীবের কল্যাণ যাঁর ব্রত এইরূপ॥
ত্রাতা পাতা রক্ষাকর্তা করুণাসাগর।
কেন তাঁয় নাহি চায় জীব সুপামর॥
কিবা জীব হেন জীব জীব যেবা নামে।
কে বল গড়িল তায় কোন্ উপাদানে॥
যে আদরে মারে তায় ফেলে মহাপাকে।
যে মারে আদরে ধরি বুকে তায় রাখে॥
দূরে রাখে সুখ-দুখে সখা সেই জন।
যত্ন করে রাঙা লুড়ি দারা-পুত্র-ধন॥
পতিততারণ প্রভু সৎবুদ্ধি-দাতা।
জ্ঞানের জনক সেবাপ্রেমাভক্তি-মাতা॥
কৃপা কর কৃপাকর হর অন্ধকার।
দেহি মে চৈতন্যরত্ন সকলের সার॥
করিয়াছ কর জীব তাহে নাহি ক্ষতি।
রাখিও অভয়পদে ষোল আনা মতি॥
নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে যেন ডাকিবারে পারি।
অকূল পাথারে কোথা ভবের কাণ্ডারী॥
হেথা অগ্নিবর্ণ গুলে পিঠ পুড়ে যায়।
চর্ম-দগ্ধ-গন্ধ সবে আঘ্রাণেতে পায়॥
সতর্ক নয়নে সবে দেখে চারি ধারে।
বলে এত গন্ধ কিসে কি পুড়ে কি পুড়ে॥
কোনমতে কেহ কিছু না পায় সন্ধান।
মথুর দেখিল বাহ্যহারা ভগবান॥
শ্রীপ্রভুর ভাব যেন শ্ৰীমথুর জানে।
তাড়াতাড়ি আসিলেন তাঁর সন্নিধানে॥
বাহ্য আনিবারে কানে দেন কৃষ্ণনাম।
কতক্ষণ পরে আসে কিঞ্চিৎ গিয়ান॥
এখন এমন যেন সিদ্ধি খেলে পরে।
এইক্ষণে আসে হুঁশ পরক্ষণে ছাড়ে॥
অবিরাম কৃষ্ণনাম দেন কর্ণমূলে।
নাহি জানে শ্রীপ্রভুর পিঠ পুড়ে গুলে।
ক্ৰমশঃ প্রকাশ বাহ্য পরে পরে।
প্রভুর নাহিক সাড়া পিঠ যায় পুড়ে॥
প্রভুর সমাধি-কথা বল কে বুঝিবে।
ছিল দেহভাব লুপ্ত সত্তা এল এবে॥
দেহেতে নামিলে মন জড় জড় স্বরে।
বলিলেন পিঠে কেন চিনচিন্ করে॥
পিঠ দেখি মথুরের পরান আকুল।
ভিতরে ঢুকেছে অগ্নিবর্ণ লাল গুল॥
মুখে নাহি সরে কথা দেখিয়া ব্যাপার।
অমনি টানিয়া আনে হাতে আপনার॥
বলে ভাল যত্ন হেতু আনিনু ভবনে।
কি হ'ল কি হ'ল কালী রক্ষা কর দীনে॥
যত দিন দগ্ধ স্থান নাহি গেল সেরে।
সবে মিলে ঘেরে তাঁরে রাখিল অন্দরে॥
মথুর দেখেন তাঁয় জীবন-জীবন।
তৎক্ষণে তাই করে যে আজ্ঞা যখন॥
ভক্তিমতী জগদম্বা ভক্তি করে তাঁয়।
সাজাইত মনোমত ফুলের মালায়॥
প্রভুর তেমতি কৃপা তাঁদের উপর।
ধরাধামে ধন্য শ্ৰীমথুর ভক্তবর॥
পরিবার-সহ বাস ল'য়ে নরহরি।
ভক্তবাঞ্ছাকল্পতরু করুণাকাণ্ডারী॥
ধন জন দাস দাসী পুরবাসিগণ।
ভক্তিমতী দারা যত নন্দিনী নন্দন॥
আপনার বলিতে আছিল তার যত।
প্রভুর সেবায় হয় সকল প্রদত্ত॥
কোটি কোটি দণ্ডবৎ মথুর-চরণে।
মাগি রামকৃষ্ণভক্তি ভিক্ষা দেহ দীনে॥
লোহা যেন সোনা হয় পরেশ-পরশে।
মথুর হইল তেন প্রভু-সহবাসে॥

Prev | Up | Next


Go to top