দ্বিতীয় খণ্ড - মধুরভাবে সাধনা
১১
বহুদিন অদর্শন ছিল শ্রীপ্রভুর।
ঘরে ল'য়ে গিয়াছিল ভকত মথুর॥
এবে পুরীমধ্যে তাঁর আগমন শুনি।
আনন্দে পূর্ণিতান্তরা হইল ব্রাহ্মণী॥
দরদর বারিধারা বহে দুনয়নে।
সবেগে বাৎসল্যভাব সমুদিত মনে॥
কতক্ষণে চন্দ্রাননে নবনী মাখন।
প্রভুরে করিয়া কোলে করিবে অর্পণ॥
উচাটন মন স্থির কিসেও না আর।
পরা বারাণসী শাড়ি গায়ে অলঙ্কার॥
হাতে থাল পরিপূর্ণ ছানা ননী ক্ষীর।
শ্রীপ্রভুর দরশনে হইল বাহির॥
গায় কৃষ্ণ-বিচ্ছেদের প্রভাসের গান।
ভাবেতে ব্রাহ্মণী নন্দরানীর সমান॥
পাগলিনী-সম গায় ভাসে আঁখিজলে।
যে শুনে সে কাঁদে আর সঙ্গে এসে মিলে॥
পুরীর ফটক-দ্বারে যবে উপনীতা।
চারিধারে বামাদলে ব্রাহ্মণী বেষ্টিতা॥
যেই দেখে শুনে হয় সেই বিমোহিত।
গাইতে লাগিল নিম্নলিখিত সঙ্গীত॥
দ্বারে দাঁড়ায়ে আছে তোর মা
নন্দরানী। তোরে নিতে আসি না
দেখে যাব চাঁদ-বদনখানি॥
আয়রে কোলে দিব তুলে বদনে
সর ননী॥
তিল-আধ প্রাণ যদি থাকে তোর মন।
ব্রাহ্মণীর হৃদি-ভাব কর বিলোকন॥
কোথায় গিয়াছে ভেসে কোথা তার প্রাণ।
কি সুখলহরী-মধ্যে এবে ভাসমান॥
কি আর রেখেছে দেখ আপনার ঘরে।
মহাপ্রেমে গেছে গ'লে প্রেমের পাথারে॥
হায়রে তপস্বী মহাঋষি মুনিগণ।
ত্রিভুবন-সর্বজন-আরাধ্যচরণ॥
আজীবন অনশন তরুতলে বাস।
অবিরত নানা ব্রত কঠোর সন্ন্যাস॥
প্রয়াস কেবলমাত্র তুচ্ছধনহেতু।
ত্রিতাপ-সন্তাপ-ভয়ে হ'য়ে অতি ভীতু॥
যোগানন্দ-ব্রহ্মানন্দ-সুখদুঃখ পার।
হ'ল না দেখিতে সাধ ব্রজের ব্যাপার॥
তুলনায় কি আনন্দ যোগানন্দ ধরে।
যে আনন্দ গোপিনীর এক বিন্দু নীরে॥
ব্রজের রহস্য কথা পরম কৌতুক।
সুখে দেখে সুখ নয় দুঃখে মহাসুখ॥
কিছুই না পায় সুখ সহাস্য বদনে।
পরম আনন্দবোধ কেবল রোদনে॥
ঢালিয়া আঁখির জল ব্রাহ্মণী হেথায়।
সুবেষ্টিতা বামাদলে ধীরে ধীরে যায়॥
গায় প্রেমমাখা গান মুগ্ধ যেন শুনে।
ভাব-বেগে বদ্ধগতি মাঝে মাঝে থামে॥
একে রমণীর কণ্ঠ মিষ্টকণ্ঠা তায়।
তদুপরি প্রেম-বেগ রাগে বাহিরায়॥
কিবা কান্তিমাখা গায় চেহারা কেমন।
আঁকিতে নারিনু ধরি কাঠির কলম॥
সুপামর চিত্রকর চিত্রে নাই হাত।
বর্ণহীন পুঁজিমাত্র কালির দুয়াত॥
অন্তর বুঝিয়া তুমি কর দরশন।
কি ঠামে চলিয়া যায় ব্রাহ্মণী এখন॥
ফটক হইতে প্রায় দশ বিঘা দূর।
যেখানে একত্রে প্রভু হৃদয় মথুর॥
হৃদয় মথুর স্বর শুনিবার আগে।
ব্রাহ্মণীর প্রেমমাখা গীত গিয়া লাগে॥
মহাবেগে বাণসম প্রভুর শ্রবণে।
বাহ্য গেল সমাধিস্থ হৈলা সেইক্ষণে॥
পশ্চাৎ মথুর শুনি কহিল হৃদয়ে।
কে বা গায় মিষ্ট গীত দেখ না এগিয়ে॥
হৃদয় একত্রে দেখে নারী কয় জনা।
তার মধ্যে ব্রাহ্মণীরে নাহি যায় চেনা॥
আভরণে রঙিন বসনে সজ্জা করা।
লুকায়েছে তার মধ্যে তাহার চেহারা॥
ব্রাহ্মণী নিকটে আসি করে নিরীক্ষণ।
সমাধিস্থ প্রভুদেব নাহিক চেতন॥
ব্রাহ্মণীও অচেতন প্রায় ভূমে পড়ে।
থাল সহ হৃদয় যাইয়া তায় ধরে॥
কিছু পরে ব্রাহ্মণী সম্বিৎ পেয়ে উঠে।
বিভোর শ্রীপ্রভুদেব নেশা নাহি ছুটে॥
শ্রীপ্রভুর সন্নিকটে বসিল ব্রাহ্মণী।
অবিরল ঢালে জল নয়ন দুখানি॥
বাঞ্ছাকল্পতরু প্রভু ভাবের বিহ্বলে।
শিশুসম বসিলেন ব্রাহ্মণীর কোলে॥
থালা থেকে ল'য়ে ননী হৃদয় আপনে।
টুকু টুকু তুলে দেয় প্রভুর বদনে॥
পঞ্চমবর্ষীয়-বয়ঃ বালক-সমান।
ব্রাহ্মণীর কোলে বসে ননী সর খান॥
আসক্তির দাস মন দেখ আঁখি মেলে।
কি ছার কাঞ্চন-নারী ল'য়ে আছ ভুলে॥
ব্রাহ্মণীর কোলে কিবা দৃশ্য করে খেলা।
ধরিয়াছে ধরাতল বৈকুণ্ঠের মেলা॥
বিনা-পণে দরশনে না হইল সাধ।
এবা কিবা নরবুদ্ধি অতি পরমাদ॥
দ্রবময়ী ব্রহ্মবারি জলাধারে ভরা।
জীবের জীবনরস সুরম্য চেহারা॥
স্বভাব-সুলভ ভাবে সদা আছে গ'লে।
উথলায় যেন তায় পবন-হিল্লোলে॥
তেমনি রসের সিন্ধু প্রভু ভগবান।
ভক্তভাব-বাতে তাহে তুলিছে তুফান॥
বিশেষতঃ শ্রীপ্রভুর বৈষ্ণব সাধনে।
ব্রাহ্মণী ভকতিমুখী ভক্তি ভাল চিনে॥
বিষম রগড় বড় তুলেন ব্রাহ্মণী।
একমনে শুন মন কহিব কাহিনী॥
কখন গোপিনীবেশ সুন্দর দেখিতে।
আনন্দলহরী ধরা আছে ডান হাতে॥
মাতোয়ারা হ'য়ে গায় নীচে লেখা গান।
যে শুনে তাহার হয় দ্রবীভূত প্রাণ॥
আয় গো আয় গোষ্ঠে,
গোচারণে যাই।
শুনচি নিধুবনে রাখালরাজা
হবেন রাই, হায় শুনতে পাই॥
পীতধড়া মোহন চূড়া রাইকে
পরাবে, হাতে বাঁশরি দিবে -
রাইকে রাজা সাজাইয়ে,
কোটাল হবে প্রাণ-কানাই।
ললিতা বিশাখা আদি অষ্ট সখীগণ,
রাখাল হবে পঞ্চজন -
তারা আবা দিয়ে বনে বনে,
ফিরাবে ধবলী গাই॥
প্রভুর পুরুষের মত নাহি কোন লাজ।
প্রিয় দরশন গায় বাউলের সাজ॥
কোমরেতে বাঁধা ডুগি বাজে তালে তালে।
গোরা গুণ-গীত গায় ভক্তি-রসে গ'লে॥
গৌর-প্রেমের ঢেউ লেগেছে গায়।
তার হিল্লোলে পাষণ্ড দলন,
এ ব্রহ্মাণ্ড তলিয়ে যায়॥
মনে করি ডুবে তলিয়ে রই,
গৌরচাঁদের প্রেম-কুমীরে
গিলেচে গো সই।
এমন ব্যথার ব্যথী কে আর আছে,
হাত ধরে টেনে তোলায়॥
প্রভু হন বাহ্যহারা ব্রাহ্মণীর গানে।
তখনি অমনি যেই ক্ষণে ঢুকে কানে॥
ভাবময়ী ভক্তিময়ী ব্রাহ্মণীর দেহ।
মানবী-আকার কিন্তু মহাদেবী কেহ॥