দ্বিতীয় খণ্ড - স্বদেশ-যাত্রা
১২
প্রভুর শাশুড়ী হেথা দিদিঠাকুরানী।
বারে বারে বন্দি তাঁর চরণ দুখানি॥
ওগো বাছা বলি প্রভু সম্বোধনে তাঁয়।
নানা রঙ্গ-পরিহাস কথায় কথায়॥
সলজ্জবদনা দিদি প্রভুর বোলে।
কথা কহিতেন মুখ আধখানি খুলে॥
কোন কালে নাহি ছিল সম্পর্ক-বিচার।
যেমন অল্পবয়ঃ শিশুর আচার॥
জনক জননী খুড়া সোদর মাতুল।
শ্বশুর শাশুড়ী শালা সব সমতুল॥
বাবু ভাই সম্পর্ক প্রভৃতি নাই জ্ঞান।
আপন অপর কেবা সকলে সমান॥
সংসার-সম্বন্ধে আছে যেরূপ ব্যাভার।
ভিন্ন ভিন্ন জনে যেন বিভিন্ন আচার॥
সে সব না ছিল কিছু শ্রীপ্রভুর ঠাঁই।
সর্বস্থানে সমরূপ লজ্জা ভয় নাই॥
শ্রীপ্রভুর শাশুড়ীর সঙ্গে রঙ্গ হয়।
শুনিয়াছি যেইরূপ শুন পরিচয়॥
প্রভু-রামকৃষ্ণ-কথা বড়ই মজার।
বাহিরে আছিল এক গাছ সজিনার॥
অবনত যত ডাল থোপা থোপা ফুলে।
প্রসারিয়া শ্রীচরণ বসি তার তলে॥
মহানন্দে মুখে হাসি প্রভু ভগবান।
শাশুড়ীরে লক্ষ্য করি গাইতেন গান॥
সজিনাফুল পাতাব শাউড়ী তোর সনে।
সজিনাফুলতলায় বসবো দুজনায়,
ফুরফুরে বাতাসে ফুল ঝোরে পোড়বে গায়,
আবার সজিনাফুলের থোপা ভেঙে
পরায়ে দিব কানে॥
হাসি হাসি দিদি আই বলিতেন তাঁরে।
কে কোথা এমন কথা কহে শাশুড়ীরে॥
বলিতে কি আছে বাপ এমন বচন।
আমি তো শাশুড়ী হই মায়ের মতন॥
উত্তর-বচনেতে প্রভু বলিতেন তাঁয়।
শাশুড়ী বলিয়া ছাপা আছে কি পাছায়॥
বসনে ঢাকিয়া মুখ ছুটে দিদি আই।
পাছু পাছু গীত গান প্রেমিক জামাই॥
শাশুড়ী-জামায়ে দেখ সম্পর্ক কেমন।
বাহ্যে এক ভিতরে কি আছে সংগোপন॥
শ্রীপ্রভুর শাশুড়ীর ভাব পূর্বেকার।
দিনে লয় হয় স্নেহের সঞ্চার॥
একদিন একত্র তথায় কত নারী।
সবাকার পদরেণু মস্তকেতে ধরি॥
প্রভুদেব ল'য়ে হাতে কুসুম-চন্দন।
সবার চরণতলে করেন অর্পণ॥
নারীগণ ত্রস্তমন শশব্যস্ত-প্রায়।
পলায়ন করে মুখ ঢাকিয়া লজ্জায়॥
দেখি প্রভু বলিতেন সবে সম্বোধিয়ে।
শ্যামার অংশেতে জন্ম যত সব মেয়ে॥
মেয়ে-রূপে মহামায়া রূপে অগণন।
তাই সমর্পিণু পদে কুসুম-চন্দন॥
পাড়াগেঁয়ে মোটা লোক বুঝিতে না পারে।
অন্তরালে প্রভু খেপা বলাবলি করে॥
আর দিন মনসার পূজা-আয়োজন।
নৈবেদ্য সাজায়ে রাখে রমণীর গণ॥
গাইতে গাইতে প্রভু শ্যামাগুণগীত।
ভাবেতে বিভোর চিত তথা উপস্থিত॥
দেখিয়া নৈবেদ্য থালে প্রভুদেব কন।
নৈবেদ্য খাইতে কেন হইতেছে মন॥
খাও তবে নারীগণে কহিল তাঁহায়।
অমনি বসিলা প্রভু নৈবেদ্য-সেবায়॥
ভাবাবেশে খাইতে লাগিলা গুণমণি।
অনিমিখ আঁখি দেখে পাড়ার রমণী॥
অন্য দিন প্রভুদেব শ্বশুরের ঘরে।
ভোজন-সময় তাঁর ভোজনের তরে॥
করি ঠাঁই ডাকিয়া আনিল একজন।
শুন কি হইল পরে অপূর্ব কথন॥
ডাকামাত্র প্রভুদেব প্রবেশিয়া ঘর।
উপবিষ্ট হইলেন আসন-উপর॥
শালী-সম্পর্কীয় এক হেঁশেলেতে যায়।
অন্নব্যঞ্জনাদি ভোজ্য সাজাতে থালায়॥
ইতিমধ্যে শ্রীঅঙ্গেতে দিগম্বরাবেশ।
উলঙ্গ ঘরের এক কোণে পরমেশ॥
অদূরে পড়েছে খসি কটির বসন।
দাঁড়ায়ে আছেন নাহি বাহ্যিক চেতন॥
হেনকালে হাতে থালা শালী ঘরে যায়।
ব্যাপার দেখিয়া ভয়ে ছুটিয়া পালায়॥
বুঝ কি বিশেষ কাণ্ড শ্বশুর-ভবনে।
উলঙ্গ দণ্ডায়মান আবাসের কোণে॥
লোকে জনে তত্ত্ব তাঁর কিছু বুঝে নাই।
একবাক্যে কয় সবে উন্মত্ত জামাই॥
কোন না কারণে তথা হরি-কথা হ'লে।
অমনি সমাধি হয় বাহ্য যায় চ'লে॥
পাড়াগেঁয়ে চাষা সবে মোটা লোকজন।
চাষ করে থাকে ঘরে সামান্য জীবন॥
অবিদিত শাস্ত্র নাহি তত্ত্ব-আলাপনা।
সমাধি ধিয়ান জপ কিছুই বুঝে না॥
প্রভুরে বুঝিবে কিসে তাহারা সকল।
সে হেতু করিত তাঁর ভাবের নকল॥