দ্বিতীয় খণ্ড - তান্ত্রিক-সাধনা
১৩
এক প্রশ্ন করিবারে পার তুমি মন।
যখন শ্রীপ্রভুদেব ব্রহ্ম সনাতন॥
কি হেতু কাহার জন্য ধ্যান-আরাধনা।
এতাধিক দেহকষ্ট সাধন-ভজনা॥
ব্যাকুলতা-অনুরাগে পূজক যখন।
হইয়া গিয়াছে তাঁর কালী-দরশন॥
নিরাকারাকারে আর সরাট-বিরাটে।
স্থূল সূক্ষ্ম চরাচর প্রতি ঘটে ঘটে॥
তবে কেন পুনরায় সমুদিত মনে।
তন্ত্রমতে যাবতীয় সাধন-ভজনে॥
প্রথম প্রশ্নের কথা কহি শুন আগে।
যখন পূজক বেশ সিদ্ধ অনুরাগে॥
সাধারণে অনুরাগে কহে যে রকম।
শ্রীপ্রভুর অনুরাগে বিভিন্ন ধরন॥
সাধারণে শব্দার্থেতে বুঝে সাদাসিধা।
প্রভুর রাগের অর্থ-বস্তু আলাহিদা॥
ইতিপূর্বে কহিয়াছি এ রাগের কথা।
এবে শুন বলি পুনঃ সংক্ষেপে বারতা॥
সতীর পতিতে টান মার যেন ছায়ে।
বিষয়ীর টান যেন অর্থাদি বিষয়ে॥
এ তিন টানের যোগে হয় যেই টান।
তদপেক্ষা টান রহে রাগে মূর্তিমান॥
একলক্ষ্য-মুখী টান রাগের প্রকৃতি।
অদম্য অরোধনীয় অতি বেগবতী॥
রাগের বেগের কথা নাহি বলা যায়।
রূপ-রস-যুক্ত স্থূল জগতে ভাষায়॥
ভাসে চিত্ত মন বুদ্ধি সন্দেহ-আগার।
গুরুর প্রগুরু ভাসে গুরু-অহংকার॥
অস্তি নাস্তি দুই ভাসে আশ্চর্য ভারতী।
সুদুর্লভ অনুরাগে বহে এই রীতি॥
অনুরাগ নামে সেটি ষোল আনা ত্যাগ।
আসক্তি-সম্বল জীবে সম্ভবে কি রাগ॥
এ রাগের অণুকণা যদি কোথা থাকে।
কলির নারদ ব্যাস শুক বলি তাঁকে॥
বায়ুবৎ সূক্ষ্ম রাগ চক্ষের অতীত।
লক্ষণে জ্ঞাপন করে কোথা সমুদিত॥
সূক্ষ্মের দারুণ তেজ এত দেহে ধরে।
দুর্বল মানবাধার ধরিতে না পারে॥
সাধনাদি স্থূল যদি ক্রিয়াকাণ্ড ঢের।
তথাপিহ সাধ্য কিছু আছে মানুষের॥
তাই প্রভু আচরিয়া সাধনা আপুনি।
দুর্বলাবিশ্বাসী জীবে দিলা আশাবাণী॥
অনুরাগে যেইমত কার্য সিদ্ধ হয়।
সাধনেও সেইমত জানিবে নিশ্চয়॥
দ্বিতীয় কারণ আর ইহার ভিতরে।
শাস্ত্রের মর্যাদা-আদি রক্ষা করিবারে॥
জগতে যতেক ধর্ম মত-পথ-রঙ্গ।
প্রায় আছে প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গ॥
কোথাও কেবল ভোগ অন্য কিছু নাই।
কোথাও বা ভোগ যোগ এক অঙ্গে ঠাঁই॥
শেষাঙ্গেতে নাহি রবে অণুমাত্র ভোগ।
অবিরাম একধারা শুদ্ধ একা যোগ॥
কে কোন্ অঙ্গের যোগ্য হয় অধিকারী।
শ্রীগুরু বাছিয়া দেন বিবেচনা করি॥
ভোগ ল'য়ে সাধকের প্রথম প্রবেশ।
পশ্চাৎ যোগেতে হয় সাধনার শেষ॥
ভোগের নাহিক লেশ প্রভুর সাধনে।
বড়ই মাহাত্ম্য-কথা শুন একমনে॥
পরিণামশীল সৃষ্টি রূপ-রসে পূর্ণ।
সূক্ষ্মদৃষ্টি-সহকারে করি তন্ন তন্ন॥
দেখিয়া শুনিয়া প্রভু জ্ঞানাগ্নি জ্বালিয়ে।
দিয়াছেন একেবারে আমূলে পুড়িয়ে॥
সতত নিবৃত্তি-পথে এক যোগ সাথী।
জন্ম থেকে গঠেছেন এ হেন প্রকৃতি॥
ত্যাগ নিষ্ঠা একাগ্রতা একমনা গুণে।
যখন সাধনা যাহা সিদ্ধ তিন দিনে॥
যাবতীয় ধর্মমত জগজনে জানা।
প্রতি মতে-পথে প্রভু করিলা সাধনা॥
দেখাইলা জগজনে কল্যাণ-নিদান।
সব মত-পথ সত্য কেহ নহে আন॥
পথ-মত ভিন্ন ভিন্ন প্রত্যেকে প্রত্যেক।
পরিণামে ফল যেটি সেটি কিন্তু এক॥
দ্বাদশবার্ষিকব্যাপী করিয়া সাধন।
ধর্মদ্বন্দ্ব জগতের করিলা ভঞ্জন॥
দৃষ্টি যদি থাকে রঙ্গ দেখহ প্রভুর।
স্থানীয়-জাতীয় নয় জগৎঠাকুর॥
মত-পথ-বিশেষের এক অঙ্গে ল'য়ে।
যদি চলে কোনজন সাধনা করিয়ে॥
যথাশ্রম প্রাণপণ যথা-অনুরাগে।
তথাপি হইতে সিদ্ধ জন্ম জন্ম লাগে॥
মহিমা মাহাত্ম্য দেখি প্রভুর এখানে।
মনবুদ্ধি-হারা হই লীলা-আন্দোলনে॥