দ্বিতীয় খণ্ড - রামাৎ-সাধনা
২
রাম লাগি প্রভুদেব চিন্তায় অস্থির।
আহার বিরাম নাই কিসে রঘুবীর॥
পাইবেন এই চিন্তা মনে অনুক্ষণ।
আরম্ভ করিলা এবে সাধন-ভজন॥
পুরীর উত্তরে এক বটবৃক্ষমূলে।
জপ ধ্যান শ্রীপ্রভুর অবিরত চলে॥
দাস্য সখ্য নানা ভাবে করেন সাধন।
যখন যেমন হয় হৃদে জাগরণ॥
দাস্যেতে হনুর ভাবে সতত বিভোর।
মহাবেগে ভাবাবেগ দেহে করে জোর॥
প্রভুর শ্রীদেহে ধরে সৃষ্টিছাড়া রীতি।
দেহ হয় ঠিক যেন মনের প্রকৃতি॥
যে ভাব যখন হয় মনেতে প্রবল।
ঠিক তার অনুরূপে তনুর বদল॥
বুঝনে না যায় কিছু প্রভুর গতিক।
যেই চক্ষে ছয় মাস রহে অনিমিখ॥
সেই চক্ষু চঞ্চল পলক প্রতিপলে।
এক লক্ষ্যে ধাবমান ভাবের প্রাবল্যে॥
ধীর মন্দ পাদক্ষেপে যাঁহার গমন।
এবে বর্তমানে গতি দিয়া উল্লম্ফন॥
বস্ত্রের লাঙ্গুল-বাস বাহিরে বাহিরে।
কভু হয় মূত্রত্যাগ বৃক্ষের উপরে॥
এই দেখি হলধারী সর্বজনে কয়।
বায়ুরোগে গদাধর উন্মত্ত নিশ্চয়॥
ভাবাবেগে কর্ম তাঁর কে করিবে রোধ।
লোকে-জনে কবে কিবা কিছু নাই বোধ॥
ক্ষুধা-নিবারণে খোলা খোসা-সহ ফল।
তৃষ্ণায় ওষ্ঠের দ্বারা পান গঙ্গাজল॥
করজোড়ে জানু গেড়ে জয় রাম ধ্বনি।
কাকুতি মিনতি শত লুটায়ে অবনী॥
দাস্যভাবে কিছুদিন হইলে বিগত।
উদিল অপর ভাব ভরতের মত॥
এখন দেহের নাই পূর্ববৎ ধারা।
সহজ যেমন দেখে লাগে চমৎকারা॥
ভাব-অনুমত হয় দেহের গড়ন।
একরূপে বহুরূপী আশ্চর্য কথন॥
কাঠের পাদুকা-সেবা এবে নিরন্তর।
স্থাপিয়া পাদুকা দুটি খাটের উপর॥
সচন্দন ফুলে পূজা অনুরাগাবেশে।
দরদর চক্ষুজলে বক্ষ যায় ভেসে॥
পাদুকাসহিত খাট করিয়া মাথায়।
কাঁদিয়া কাঁদিয়া প্রভু বেড়িয়া বেড়ায়॥
মুখে রাম কোথা রাম হা রাম যো রাম।
কবে পাব অযোধ্যায় রাম প্রাণারাম॥
বিরহ খেদোক্তি কত শুনে প্রাণ ফাটে।
এইরূপে দুই তিন চারি দিন কাটে॥
ধন্য নর-বেশে লীলা বুঝে কোন্ জনে।
তুমি রাম তুমি সীতা তবু কাঁদ কেনে॥
কিসের লাগিয়া কাঁদ, কাঁদ কার তরে।
নাহি বুঝি কি রহস্য ইহার ভিতরে॥
যদি বল জীবশিক্ষাহেতু আচরণ।
জীবে দেখি রাম লাগি করিবে রোদন॥
নিবেদন আছে এক কহি তব ঠাঁই।
করুণা করিয়া কহ জগৎগোসাঁই॥
ধরা থেকে অতি দূর শূন্যের উপর।
কেমনে জনমে জল ডাবের ভিতর॥
কারিগর কহ কেবা শকতি কাহার।
কি কলে-কৌশলে ফলে জলের সঞ্চার॥
তুমি বিনা এ কলের কর্তা কেহ নয়।
হাতে কি লইয়া জল দিতে তায় হয়॥
না কি জনময়ে জল কৌশলের জোরে।
বিধিমতে শস্যে পূর্ণ ফলে করিবারে॥
যদি এত কারিগুরি সঙ্কেতেই চলে।
কেন জীবে না কাঁদিবে রাম রাম ব'লে॥
যদি বল সশরীরে হই অবতরি।
ধনরত্ন ভক্তি মুক্তি করি ছড়াছড়ি॥
তবু এক নিবেদন আছে শ্রীচরণে।
সকল ঝিনুকে মুক্তা না জনমে কেনে॥
সকলেই থাকে সেই সাগরের নীরে।
কেহ মাংসময়গর্ভ কেহ মুক্তা ধরে॥
অবোধ্য অচিন্ত্য যেন তুমি নিজে হরি।
লীলাখেলা কার্য তব সেইমত ধরি॥
অসীম অনন্ত তুমি বুঝে সাধ্য কার।
বুঝাবুঝি কার্য নহে মম অধিকার॥
চরণসেবায় রব এই সাধ করি।
রতি-মতি দেহ পদে কল্পতরু হরি॥
রামরূপ-ধ্যান মুখে রামনাম-ধ্বনি।
সমান ধারায় যায় দিবস-যামিনী॥