দ্বিতীয় খণ্ড - যোগ-সাধন
৫
প্রভুর রকম দেখি তোতা বুদ্ধিহারা।
বুঝিয়া না পারে কিছু করিতে কিনারা॥
শ্রীপ্রভু তোমার খেলা বুঝে সাধ্য কার।
তুমি জগতের গুরু কে গুরু তোমার॥
ধরি নানারূপ কর নরবৎ রীতি।
কার্যেতে প্রকাশ পায় অতুল শকতি॥
যোগিজন-অগ্রগণ্য যোগসিদ্ধ তোতা।
সেও না খুঁজিয়া পায় কিছুই বারতা॥
সর্বদায় ঘোল খায় মাথা যায় ঘুরে।
কাছে যেতে কৈলে চেষ্টা পড়ে বহুদূরে॥
তাই কহে মায়া সব সত্য কিছু নয়।
শুন কি হইল পরে তার পরিচয়॥
মা বলিয়া যবে প্রভু শ্যামায় সম্ভাষে।
শক্তিতে বিশ্বাস শুনি তোতাপুরী হাসে॥
সাকার ভ্রান্তির কথা বৈদান্তিক স্থানে।
মায়ার ব্যাপার কয় কিছু নাহি মানে॥
শক্তির সাবস্তে প্রভু যথা কথা কন।
তোতা তত প্রতিবাদ করে সমর্থন॥
সকল মায়ার খেলা কিছু নয় সত্য।
তোতার উত্তর এই প্রভু কন যত॥
কেমনে নরের হৃদে উপজে বারতা।
উভয় সাকার নিরাকার এক কথা॥
একত্রিত বিপরীত ভাব এক ঠাঁই।
সকল রঙের ভূমি জগৎ-গোসাঁই॥
প্রভুর কৃপায় যাহা হৃদয়ে আভাস।
না পাই কথায় তায় করিতে প্রকাশ॥
সাকারেতে রূপরসগন্ধাদি আকার।
নিরাকারে কিছু নাই খবর তাহার॥
মহান তটিনী-স্রোতে ভাসমান তরী।
আরোহী কতই দেখে প্রান্তর নগরী॥
ফলে ফুলে পরিপূর্ণ বৃক্ষলতাগণ।
উচ্চশৃঙ্গ গিরিবর বিপিন কানন॥
মনোহরা ধরা পরা নানাবিধ সাজে।
দিনেশ চন্দ্রিমা তারা গগনে বিরাজে॥
পলকে পলকে উঠে ভাবের লহরী।
কিন্তু যবে সিন্ধুগত হয় সেই তরী॥
তখন কি দেখে দেখ আরোহীর গণ।
কারিগুরি রকমারি অদৃশ্য এখন॥
সকল মিশেছে জলে কিছু নাহি আর।
যে দিকে নেহারে হেরে বারি একাকার॥
গেছে চন্দ্র গেছে সূর্য গেছে গিরিবর।
বিপিন কানন গেছে গিয়াছে প্রান্তর॥
গেছে ফুল-ফল-ভরা বৃক্ষলতাগণ।
মনোহরা সাজে পরা ধরা সুশোভন॥
ভাবের লহরী গেছে তাহার সংহতি।
গেছে মন গেছে প্রাণ গেছে বুদ্ধি স্মৃতি॥
গিয়াছে আরোহিগণ গিয়াছে তরণী।
কি দেখে কি দেখে আর কিছু নাহি জানি॥
নিরাকার কি প্রকার প্রভুর বচন।
গেলে তথা নহে আর পুনরাগমন॥
জল মাপিবারে গেলে নুনের মানুষে।
গলে যায় ঠাণ্ডা বায় ফিরে নাহি আসে॥
কিন্তু মন দেখিয়াছি প্রভু পরমেশ।
ক্ষণে ক্ষণে ভ্রমিতেন এদেশ ওদেশ।
দেহাদিবিলুপ্ত ভাবে যদি এই ক্ষণে।
কিছু পরে মা মা রব ফুটে শ্রীবদনে॥
জীবে যদি গুরুবলে সপ্তমেতে যায়।
আর কার নাহি সাধ্য তাহারে ফিরায়॥
শ্রীপ্রভুর মহাশক্তি যে শক্তির বলে।
এই স্থিতি অতি ঊর্ধ্বে এই অধস্তলে॥
হেন প্রভু মানুষের বুঝা বড় দায়।
একঘেয়ে সিদ্ধযোগী কত ঘোল খায়॥
সাধন-ভজনে হয় গুরু-প্রয়োজন।
আগাগোড়া চিরকাল তাঁহার নিয়ম॥
পালিবারে স্বকৃত নিয়ম ভগবান।
লোকশিক্ষাহেতুমাত্র গুরুরে আনান॥
জগতের গুরু যিনি হর্তা পাতা ত্রাতা।
কে আবার গুরু তাঁর কেবা শিক্ষাদাতা॥
যেবা মহাভাগ্যবান গুরুরূপে আসে।
অমূল্য রতন পায় প্রভুর সকাশে॥
দম্ভ ভারি তোতাপুরী না মানে সাকার।
যা দেখে যা শুনে কয় কৌশল মায়ার॥